শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি নেই আমু-ওমরের, অনেক প্রার্থীকেই চেনেন না ভোটাররা
সারা দেশে নির্বাচনি প্রচারণা জমে উঠলেও ঝালকাঠিতে এর কোন প্রভাব পড়ছে না। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় আমির হোসেন আমু ও ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম এর প্রচারণা কমে গেছে বলে জানিয়েছেন ভোটাররা। আবার এই দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর যারা প্রতিদ্বন্দ্বি, তাদের কাউকেই চেনেন না অধিকাংশ ভোটাররা। তাই ঝালকাঠির দুটি আসনেই নির্বাচনি উত্তাপ নেই বললেই চলে। যদিও মাঝেমধ্যে ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার প্রার্থী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়।
সুগন্ধা, বিষখালী ও ধানসিঁড়ি নদী বেষ্টিত জেলা ঝালকাঠি। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ এই জেলাকে এক সময় দ্বিতীয় কলকাতাও বলা হতো। এ জেলায় রয়েছে দুটি সংসদীয় আসন। ঝালকাঠি-১ আসনটি রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা নিয়ে এবং ঝালকাঠি-২ আসন সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর (নৌকা) বীর উত্তম, জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. এজাজুল হক (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী জসীম উদ্দিন তালুকদার (সোনালী আঁশ), বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী মজিবর রহমান (ডাব), জাকের পার্টির আবু বক্কর সিদ্দিক (গোলাপ ফুল), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী মামুন সিকদার (ছড়ি), স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য এম মনিরুজ্জামান মনির (ঈগল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার আবুল কাশেম ফখরুল ইসলাম (ট্রাক)।
এ আসনে মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৭২ হাজার ৭৬৫ জন। বর্তমান ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ৮ জন। পুরুষ ১ লাখ ৭ হাজার ৮৬০ জন। নারী ১ লাখ ৪ হাজার ১৪৫। থানা-দুটি (রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া), ইউনিয়ন ১২টি, ভোট কেন্দ্রে ৯০টি।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-১ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়। প্রথম সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-রাজাপুর নিয়ে গঠিত আসনে আমির হোসেন আমু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয়, ১৯৯১ সালে পঞ্চম, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ এবং ২০০১ সালে অষ্টম সংসদে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐকমত্যের সরকারে যোগ দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। আবার ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের (বীর উত্তম) কাছে হেরে যান। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ২০০১ সাল পর্যন্ত আটটি সংসদ নির্বাচনে সাতবারই এ আসনে আওয়ামী লীগকে হারতে হয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে। ২০০১ সালে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে ভূমি প্রতিমন্ত্রী এবং পরে আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে এলাকায় রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করেছিলেন ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বজললুল হক হারুন নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরে আসে। টানা তিনবার তিনি এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। গত ২৯ নভেম্বর কারাগার থেকে বের হয়ে ৩০ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকার মনোনয়ন পান শাহজাহান ওমর। পাল্টে যায় ঝালকাঠি-১ আসনের দৃশ্যপট। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী যোগ দেন শাহজাহান ওমরের সঙ্গে। নামেন নৌকার নির্বাচনি প্রচারণায়। এ আসনে শাহজাহান ওমরের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নয় বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এম মনিরুজ্জামান মনির। তিনিও প্রধানমন্ত্রী ও নৌকার প্রতি আস্থা রেখে গত ২৬ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। এরপরই নির্বাচনি মাঠে শাহজাহন ওমর একাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর আর শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বি রইল না। আর যারা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে নির্বাচনে বিভিন্ন দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের এলাকায় কেউ চেনেন না।
রাজাপুর সদর ইউনিয়নের বাইপাস মোড় এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনি মাঠে নৌকার প্রার্থী শাহজাহান ওমর ছাড়া অন্য যারা প্রার্থী হয়েছেন, কাউকেই আমি চিনি না। এলাকায় তাদের কখনো দেখিনি। কোন অনুষ্ঠানেও তাঁরা আসেননি। এমনকি প্রার্থী হয়েও কোন পোস্টার নেই তাদের, কোথায় মাইকিংও শোনা যাচ্ছে না। এমন প্রার্থী না থাকলেই ভালো হতো।
এদিকে ঝালকাঠি-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু (নৌকা), জাতীয় পার্টির প্রার্থী নাসির উদ্দিন এমরান (লাঙ্গল) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. ফোরকান হোসেন (আম)। এ আসনে মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ৯০৪ জন। বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪২ হাজার ১৫৬ জন। পুরুষ ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯০০। নারী ১ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৪। থানা দুটি (সদর ও নলছিটি), ইউনিয়ন ২০টি, ভোট কেন্দ্রে ১৪৭টি।
১৯৯৬ সালের পূর্বে নলছিটিতে প্রতি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কমিটি করার মত লোক পাওয়া যেত না। সেখানে এখন প্রতি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর অভাব নেই। আর ঝালকাঠি সদরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা সব সবসময়ই ভাল ছিল। এমনকি এরশাদের জাতীয় পার্টির শাসন আমলেও ঝালকাঠি পৌর এলাকায় নৌকা প্রতীকে বেশি ভোট পেত। মূলত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আমির হোসেন আমু টেকনোক্রেট কোটায় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ সময় তিনি নলছিটি এবং ঝালকাঠিতে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ২০০০ সালে এ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে আমির হোসেন আমু এমপি নির্বাচিত হয়ে উন্নয়নের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। ঝালকাঠি সদর আসনে আমির হোসেন আমুই প্রথম পূর্ণমন্ত্রী। তিনি ছাড়া এ আসনে এখন পর্যন্ত অন্য কোন রাজনীতিবিদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাননি। তিনি গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার এমপি হয়েছেন এ আসন থেকে। তাই ঝালকাঠি জেলাজুড়ে আমির হোসেন আমুর ব্যাপক প্রভাব ও জনপ্রিয়তা রয়েছে।
আমির হোসেন আমুর শক্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী নেই এ আসনে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী নাসির উদ্দিন এমরান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. ফোরকান হোসেনকে চেনেন না ভোটাররা। নির্বাচনি মাঠে তাদের নেই কোন পোস্টার। এমনকি তাদের কোন কর্মী সমর্থকরাও মিছিল, মিটিং কিংবা মাইকিংও করছেন না। এতে ভোটের মাঠ একাই গরম রেখেছেন আমির হোসেন আমু। প্রতীক বরাদ্দের পর কয়েকটি পথসভা করে ঢাকায় চলে যান আমু। এর পর থেকে তাঁর নেতাকর্মীরা কোন বিভিন্ন ইউনিয়নে সভা সমাবেশ করে যাচ্ছেন। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় জমে ওঠেনি নির্বাচনি খেলা। নিরুত্তাপ এ আসনের নির্বাচনও।
ঝালকাঠির নলছিটি শহরের থানা সড়কের বাসিন্দা মো. ইদ্রিস হাওলাদার বলেন, নলছিটিতে নির্বাচনের কোন খবর নেই। মাঝেমধ্যে নৌকার মাইকিং শোনা গেলেও, অন্য দলের কোন প্রার্থীকে আমরা চিনি না। তাদের চেহারাও দেখিনি। এরা শুধু নামেই প্রার্থী হয়েছেন। এ আসনে আমির হোসেন আমুর ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো নির্বাচন হবে।
ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার মো. শাহ আলম বলেন, আমরা নির্বাচনি মাঠ গরম রেখেছি। ঝালকাঠি-২ আসনে আমির হোসেন আমুর পক্ষে প্রতিদিন মাইকিং ও সভা-সমাবেশ হচ্ছে। আশা করি আমির হোসেন আমুর বিজয় সুনিশ্চিত।