ঢাবি ছাত্রের আত্মহত্যা : ভালো চাকরির স্বপ্ন ছিল সোহাগের
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/03/18/photo-1458280952.jpg)
ঝিনাইদহের এক কৃষক পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে গেল। স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করবেন। ফিরে আসবে পরিবারের সচ্ছলতা। একমাত্র মেয়ের লেখাপড়ার খরচ নিয়েও ভাবতে হবে না তাদের। গেল মঙ্গলবার বেলা ১২টা ৭ মিনিটে সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল পরিবারটির।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার একতারপুর গ্রাম। এ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে তারেক আজিজ সোহাগ। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২৮ বছর। ২০১৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর বাবা আবদুল খালেক। মা সাদিয়া বেগম। বোন শারমীন জুথি যশোর এমএম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পড়েন। বাবার দিনমজুরিতে সংসার চলে। চাচা হাফিজুর রহমান এইচএসসি পাস করে ব্যবসা করেন। দুই ফুপু জোবেদা খাতুন ও নিলুফার ইয়াসমীন এমএ পাস। তাঁরা শিক্ষকতা করেন। চাচাতো ভাই মাহমুদ হাসান জিছান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অপর চাচাতো ভাই সাইফুল ইসলাম পলাশ এমএ পাস করে কালীগঞ্জ শহরে ব্যবসা করেন। দুই ফুপুর উৎসাহে একতারপুর মাধ্যমিক স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পরে সোহাগ যশোর ক্যান্টমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর প্রথমে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হন। এর পরের বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে ভর্তি হন। হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ৪৪৯ নম্বর রুমে শিক্ষাজীবন কাটে তাঁর।
গত বৃহস্পতিবার ১০ মার্চ বেলা ১১টার দিকে নিজ বাড়িতে কীটনাশক পান করেন সোহাগ। সেদিন দুপুরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে পরের দিন শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে নেওয়া হয় যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসার উন্নতি না হওয়ায় গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিনই বেলা ১২টা ৭ মিনিটে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যু আশপাশের গ্রামের মানুষকেও কাঁদিয়েছে। পরিবারে অভাব ছিল, কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না। সবার প্রশ্ন, এরপরও কেন এমন হলো?
গতকাল বৃহস্পতিবার কালীগঞ্জ উপজেলার একতারপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সোহাগের বাড়িতে সুনসান নীরবতা। কেউ কথা বলতে পারছেন না। শব্দ করে কান্নার শক্তি নেই তাঁদের। বুধবার গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাঁকে। মা সাদিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ছেলের কবরের দিকে। বোনের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। চাচা হাফিজ, ফুপু জোবেদা খাতুন ও নিলুফার ইয়াসমীনের কথা বলার শক্তি নেই। সোহাগের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন তাঁরা।
ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ছোট চাচা হাফিজুর রহমান জানান, অনার্স তৃতীয় বর্ষের পড়ালেখার সময় মানসিকভাবে ভারসাম্য হারাতে থাকেন সোহাগ। উল্টা-পাল্টা চিন্তায় পেয়ে বসে তাঁকে। গ্রামের সহপাঠীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলে বাড়িতে এসে সোহাগ তাঁদের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁরা জানান, পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটি চাকরি করার আশা ছিল তাঁর। চাচাতো ভাই জিসান বলেন, অনেক স্বপ্ন ছিল বড় ভাই সোহাগের। এমএ পাস করার পর কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে কখনো তিনি যাননি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার জন্য দরখাস্ত করেও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা দিতে যাননি।
সোহাগের বোন শারমীন জানান, বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর ভাই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, যশোর এবং ঝিনাইদহের মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়েছে। সব শেষ তাঁকে গত ২ মার্চ স্থানীয় বেঙ্গল ডায়ানস্টিক সেন্টারের ডা. মো. আবদুল্লাহ রুমীর কাছ থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, ঘটনার দিন সকাল থেকে ঘুমিয়ে ছিলেন তাঁর ভাই। বেলা ১১টার দিকে কীটনাশক পান করেন তিনি। পরিবারের লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে বিষমুক্ত করার চেষ্টা হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকার শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি, নম্বর ৯১৪) করেন কর্তব্যরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মঈনুল ইসলাম। এরপর গত ১৬ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সোহাগের মরদেহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাঁর এ অকালমৃত্যু এলাকার কেউ মেনে নিতে পারছেন না। ১৭ মার্চ তাঁকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।