মায়ের মুখ থেকে পড়া শুনে মুখস্থ করে এসএসসিতে দৃষ্টিহীন ঐতির সাফল্য
জন্ম থেকেই পৃথিবীর রূপ-রঙ দেখতে পান না ঐতি রায়। তার কাছে দিন-রাতের পার্থক্য নেই। তবু তার অদম্য স্পৃহা ও কঠোর অধ্যবসায়ের কাছে হার মেনেছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছেন তাক লাগানো সাফল্য। এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ গ্রেড পেয়েছে সে। মায়ের মুখ থেকে পড়া শুনে মুখস্থ করে সে পেয়েছে জিপিএ ৪ দশমিক ৩৯।
মোংলার হলদিবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ঐতি। মায়ের মুখ থেকে পড়া শুনে মুখস্থ করে এবং একই এলাকার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিজয়া হালদারের শ্রুতি লেখকের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ঐতি।
মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের হলদিবুনিয়া গ্রামের বালুর মোড় এলাকায় ঐতির বাড়িতে সোমবার (১৩ মে) ঐতির বাবা অনুপম রায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। অনুপম রায় বলেন, ‘জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন আমার মেয়ে। পরীক্ষায় সে এই রেজাল্ট করবে ভাবতে পারিনি। ছোটবেলা থেকে মেয়ের পড়াশোনায় খুব আগ্রহ ছিল। আমরা সেভাবেই তাকে যত্ন করে স্কুলে ভর্তি করে পড়াশোনা করিয়েছি।’
অনুপম রায় জানান, একমাত্র মেয়েকে মা শংকরি রায় প্রথমে শ্রুতি লেখনির মাধ্যমে বাড়িতে পড়াশোনা শেখান। এভাবে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ঐতি। পরীক্ষার হলে ঐতি মুখস্থ বলত আর একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বিজয়া হালদার তা পরীক্ষার খাতায় লিখত। এভাবে সে সবগুলো পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাস করেছে।
ঐতির মা শংকরি রায় বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ঐতির পড়াশোনার আগ্রহ দেখে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতাম। ওর জীবনের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করবেই। এখন সে এসএসসি পাস করেছে। আমরা খুব খুশি, স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
নিজেদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে শঙ্কিত ঐতির বাবা-মা। মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান তারা। এ জন্য ঐতির পরিবার সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
নিজের এমন সফলতা নিয়ে ঐতি রায় বলেন, ‘জন্ম থেকে আমি দৃষ্টিহীন, কিন্ত পড়ালেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। সে অদম্য ইচ্ছে থেকেই আমার এই সফলতা। পড়াশোনার কাজে আমার মা আমাকে সহযোগিতা না করলে আজ এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। মা পাশে বসে রিডিং পড়ত, আমি সেটা মুখস্থ করতাম। এভাবেই লেখাপড়া চালিয়ে এসেছি।’ পড়াশোনা শেষ করে সরকারি একটা চাকরি এবং আবৃত্তির শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নের কথাও জানায় মেধাবী এই শিক্ষার্থী।
ঐতির স্কুল হলদিবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ হালদার বলেন, ‘ঐতির বাবা অনুপম রায় এবং আমি ছোটবেলার বন্ধু। সে তার দৃষ্টিহীন মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। আমি তাকে বলি, আমার স্কুলে দাও বাকিটা আমি বুঝব। এরপর ঐতিকে খুব যত্ন করে পড়াশোনা করাই। সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল। ঐতি ৪ দশমিক ৩৯ পেয়ে এসএসসি পাস করে আমার এবং স্কুলের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা তার এই ফলাফলে খুশি।’
এ বিষয়ে মোংলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিশাত তামান্না বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ঐতি রায়ের এমন প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছি। মেধা না থাকলে এমন ফল করা কোনোভাবেই সম্ভব না। এখন ঐতির চোখের চিকিৎসা জরুরি। এ ছাড়া সে যাতে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’