মৃত্যুপুরী সাভারে নিহত বেড়ে ৩৩
চারদিকে দিকে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণহীন। উন্মুক্ত আর বিক্ষিপ্ত জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে আশুলিয়া, ধামরাই ও সাভার মডেল থানা। আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি, অফিস ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে এখনো জ্বলছে আগুন। থমথমে সাভার।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালানোর পরও সাভারে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩-এ। একদিনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষের মৃত্যুতে বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় চলছে স্বজন হারানোদের আর্তনাদ। এখনও বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পড়ে আছে অজ্ঞাতনামা অনেকের লাশ।
সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার ইউসুফ আলী বলেন, ‘চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতালেই গুলিবিদ্ধ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি। পরিচয়হীন একজনের লাশ এখনও পড়ে আছে। থানা পুড়িয়ে দেওয়ায় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।’
আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘নিহত তিনজনের মধ্যে দুজনের লাশ স্বজনরা নিয়ে গেছেন। অজ্ঞাতনামা একজনের লাশ হাসপাতালে পড়ে আছে। থানায় খবর দিব সে উপায় নাই। আগুনে থানা পুড়ে গেছে। অজ্ঞাতনামা এই মরদেহ নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। ১৮ ঘণ্টা ধরে পরে থাকা লাশে পচন ধরেছে, দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে।’
সাভার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক শেখ কবির জানান, তিনজনের লাশ হাসপাতালে পড়ে ছিল। গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) দিনগত গভীর রাতে তাদের পরিচয় সনাক্ত করে স্বজনরা লাশ নিয়ে যান।
হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে সোমবার বেলা ১১ টার পর থেকেই শুরু হয় পুলিশের নির্বিচার গুলি। সাভারের রেডিও কলোনী এলাকায় মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবুন নবীর চোখে ও দেহের বিভিন্ন স্থানে খুব কাছ থেকে গুলি করে শুরু হয় পুলিশের ফায়ারিং।
সৈয়দ হাসিবুন নবী বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও গাড়ি থেকে শুনতে পাই পুলিশ বলছে, ওখানে কে! পাশে থাকা পুলিশ সদস্য বলেন স্যার সাংবাদিক। ওইটাকেউ গুলি কর। তারপরে খুব কাছ থেকে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।’
‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘিরে আশুলিয়ার বাইপাইল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া জনতার স্রোত লক্ষ্য করে চলে পুলিশের নির্বিচার গুলি।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালানোর খবরে নিমেষেই চিত্র পাল্টে যায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা। নিরাপত্তার সব দায়িত্ব ছেড়ে নিজেদের জীবন নিয়েই সংকটে পড়ে পুলিশ সদস্যরা।
বিকেল ৩টার পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে পুলিশ থানা অভিমুখে ছুটতে থাকলে তাদের পিছনে ছুটে জনতার স্রোত।
প্রাণ বাঁচাতে শুরু হয় ধামরাই, আশুলিয়া ও সাভারে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ এমনকি শিক্ষার্থীরা গুলিবিদ্ধ হয়ে আসতে থাকেন হাসপাতালে। অনেকের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই। এমন পরিস্থিতিতে জনতার ক্রোধ আছড়ে পড়ে থানাগুলোতে।
এক পর্যায়ে থানাগুলো ঘিরে ক্ষুব্ধ জনতা হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে হামলা চালানো শুরু করলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। এভাবে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয় সাভার মডেল থানা পুলিশের সদস্যদের।
এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে জনতার স্রোত লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশ সদস্যরা সাভার থানা রোড হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে সাভার সেনানিবাসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে ছাত্র-জনতা তাদের পিছু নেয়। পলয়নপর পুলিশ সদস্যরা সাভার সেনানিবাসে প্রবেশ করলে ধেয়ে আসা ছাত্র-জনতাকে ফটকে আটকে দেন সেনাসদস্যরা।
এ সময় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হ্যান্ড মাইক নিয়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা শান্ত হোন। সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। আপনারা কেউ আইন হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশ সদস্যরা এসেছে। আমরা তাদের নিরস্ত্র করে আটক করেছি।’
এর আগে আশুলিয়া, ধামরাই ও সাভার মডেল থানায় অবস্থানরত পুলিশরা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ব্যর্থ হন। ততক্ষণে নির্বিচার গুলির নির্দেশ দেওয়া অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা তাদেরকে বিপদে ফেলে কৌশলে পালিয়ে যান।
আজ মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালে প্রাণে বেঁচে ফেরা একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের এমন ঝুঁকির মুখে রেখে স্যাররা পালিয়ে গেল! আল্লাহ না থাকলে তো আমরা ভর্তা হয়ে যেতাম! জনতার বন্ধু হিসেবে পুলিশ না হয়ে দলীয় পেটোয়া বাহিনী হয়ে মানুষের ক্ষোভ আর ঘৃণার পাত্র হয়েছি। অথচ হুংকার দেওয়া স্যাররা উধাও।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কি নিজেরা গুলি করতে পারি। আদেশ করেন আমাদের ঊর্ধ্বতনরা। তাদের আদেশে ফোর্স গুলি ছুঁড়েছে। আমাদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রেখে তারা কেটে পড়েছেন। কি বলবো! লজ্জা হয়। এদের মতো ভীরু, কাপুরুষ ও স্বার্থপর কর্মকর্তাদের অধীনে আমরা কাজ করেছি।’
অন্যদিকে হাসিনার পালানোর পর গা ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরাও। পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে যান আত্মগোপনে। সাভারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের বাসভবন অফিস ও কার্যালয় ঘিরে চলতে থাকে ক্ষুব্ধ জনতার হামলা।
সরেজমিনে দেখা যায়, হেমায়েতপুরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফকরুল আলম সমরের বাসা, ঋষিপাড়ায় সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের রাজ প্যালেস, ইমান্দিপুরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু আহমেদ নাসিম পাভেলের বাসা, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, সহ সভাপতি নিজাম উদ্দিন আহমেদ টিপুর বাড়িতেও আগুন দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।