পূজার ছুটিতে
সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিছনাকান্দি
সামনে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজের মায়াজাল। সেখান থেকে নেমে আসা ঝরনার অশান্ত শীতল পানির অস্থির বেগে বয়ে চলা, গন্তব্য নদীর বুক। পথে যেতে দূর থেকেই পাহাড়ের সৌন্দর্য মন কাড়বে আপনার। মন চাইবে দুই হাতে জড়িয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করতে। এখানে বর্ষাস্নাত প্রকৃতি যেন সেজে ওঠে সবুজের আচ্ছাদনে। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যলীলা দেখে মন বারবার গেয়ে উঠতে পারে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে/চেনাশোনার কোন বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে/সেখানে অকারণে যায় ছুটে’।
বলছি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিছনাকান্দির কথা। বিছনাকান্দির মূল আকর্ষণ হচ্ছে ভারতের উঁচু পাহাড়ের ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ শীতল জলধারা এবং দূরের আকাশচুম্বী পাহাড়ের সৌন্দর্য। পানির গভীরতা বেশি নয় বলে পরিষ্কার পানিতে উঁচু-নিচু পাথরগুলোকে দেখা যায়। নদীটির দুই পাশেও রয়েছে পাথরের সারি। সামনের দিকে তাকালে ঝরনা এবং উঁচু পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সারিগুলো আপনার মন কাড়বে। তবে এই সবগুলো পাহাড় এবং ঝরনার অবস্থানই ভারতে।
পাথরপূর্ণ নদী, নদীর দুই পাশে পাথরের স্তূপ, মাঝখানে পাথরগুলোর বুক ছুঁয়ে শীতল পানির বয়ে চলা আর সম্মুখে উঁচু পাহাড়ের মনহরণকারী সুন্দরের সমাহার, এসব কিছু মিলে প্রকৃতি যেন এক জলপাথরের স্বর্গ রচনা করেছে এখানে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যের মাঝে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে আপনার কেমন লাগবে একটু ভেবে দেখুন তো। একটু সময় করে আপনিও বিছনাকান্দির এই সৌন্দর্য দেখে আপনার চোখ জুড়িয়ে আসতে পারেন, পাশাপাশি শীতল পানির স্রোতের গা ভিজিয়ে মনে জাগিয়ে তুলতে পারেন অন্যরকম ভালোলাগা।
কীভাবে যাবেন
বিছনাকান্দি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত। সিলেট শহর থেকে বিছনাকান্দির দূরত্ব প্রায় ৩৯ কিলোমিটার। বিছনাকান্দি যেতে হলে প্রথমে বাসে বা ট্রেনে চলে যান সিলেট শহরে। সেখান থেকে সিএনজি বা মাইক্রোবাস ভাড়া করে আপনাকে যেতে হবে হাদারপার। সিএনজি ভাড়া করলে খরচ পড়বে ১০০০-১৫০০ টাকা, তবে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করে গেলে খরচ আরো কম পড়বে। আপনি যদি মাইক্রো ভাড়া করে যান, তাহলে খরচ পড়তে পারে ৪০০০-৭০০০ টাকা। আপনি সিলেটের আম্বরখানা থেকে বিছনাকান্দি যাওয়ার অনেক গাড়ি পাবেন। পথের রাস্তা মোটেও সুবিধার নয়, রাস্তা সরু এবং ভাঙা। সিলেট শহর থেকে হাদারপাড় পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা । হাদারপাড় পৌঁছে আপনি ঘাটে সারি সারি মোটর বোট বা নৌকা দেখতে পাবেন। একটু দাম-দর করে বোটে উঠে পড়তে পারেন। একটি মোটর বোট ভাড়া লাগতে পারে ১২০০-১৮০০ টাকা, বসতে পারবেন ১০-১২ জন। বোটে চড়ে ৪০ মিনিটে আপনি পৌঁছে যাবেন প্রকৃতির রাজ্য বিছনাকান্দিতে।
বিছনাকান্দির সৌন্দর্য
বিছনাকান্দি যেতে পথে যে নদীটি পড়বে তার নাম পিয়াইন নদী। পিয়াইন নদীর অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। বর্ষাকালে নদীটি ভারতের পাহাড়ি ঝরনা থেকে নেমে আসা শীতল জলে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। নদীর দুই পাশে মাঝে মাঝে পাথরের স্তূপ, আবার কখনো বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের বিছনা দেখতে পাবেন। নদীতে বসেই আপনি দূরে ভারতের পাহাড়গুলো দেখতে পাবেন। সে এক অন্য রকম ভালো লাগা। মনে হবে যেন প্রকৃতি তার মায়াজাল দিয়ে আপনাকে কাছে ডাকছে। কখনো কখনো পাহাড়ি ঝরনাগুলো পাহাড়ের বুকে জমে থাকা স্বচ্ছ বরফের মতো মনে হতে পারে আপনার কাছে। চারদিকে সবুজের সমারোহ আপনার মনকে আনন্দের ভরিয়ে তুলতে পারে। মনে হতে পারে উঁচু সারি সারি পাহাড় তার উচ্চতা দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে মেঘের ভেসে বেড়ানোকে।
কখন যাবেন
বিছনাকান্দির আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে। কারণ এ সময় ভারত থেকে নেমে আসা জলধারা বিছনাকান্দির সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। সে ক্ষেত্রে জুন থেকে অক্টোবর হচ্ছে বিছনাকান্দি যাওয়ার সবচেয়ে উত্তম সময়। এ সময়ের সবুজ প্রকৃতি আপনাকে মোহিত করবে।
কিছু করণীয়
১. সকাল সকাল রওনা দিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগে ফেরত আসুন কারণ সিলেট থেকে হাদারপাড় যাওয়ার রাস্তার অবস্থা ভালো নয় এবং পথে সন্ধ্যার পর নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
২। বিছনাকান্দি পাথরে পূর্ণ একটি জায়গা। সুতরাং হাঁটার সময় একটু সাবধানে হাঁটবেন।
৩। বিছনাকান্দির জলধারা খুবই মায়াবী এবং এর গভীরতা কম। তাই বলে অসাবধান হলে চলবে না। কারণ পানির স্রোত অনেক বেশি এবং পানির নিচের পাথরগুলো উঁচু-নিচু। একটু অসাবধানতাই কোনো দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
৪। মনে রাখবেন বিছনাকান্দি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে খুব বেশিদিন আগে নয়। তাই এখানে এখনো তেমনভাবে পর্যটন সুবিধা গড়ে ওঠেনি।
৫। বিছনাকান্দিতে কোনো খাবার হোটেল নেই বললেই চলে। সুতরাং সেখানে যাওয়ার আগে হাদারপাড় থেকে খাবার খেয়ে নিন।
৬। বিছনাকান্দি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত এবং এর খুব কাছ থেকে ভারতের উঁচু পাহাড়, ঝরনা এবং একটি ব্রিজ দেখা যায়। তবে সাবধান খুব বেশি সামনে যাবেন না, কারণ বাংলাদেশ সীমানার বাইরে চলে গেলে বিপদ হতে পারে।
৭। সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি এবং কিছু খাবার রাখতে পারেন, কারণ বিছনাকান্দির মায়াময় সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে এগুলো কাজে লাগবে ।
৮। রোদ থেকে বাঁচতে সঙ্গে হ্যাট বা টুপি এবং সানগ্লাস রাখতে পারেন।
৯। প্রকৃতির এই সুন্দর লীলাভূমিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে এর সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না।