ইনানী সৈকতে কেন যাবেন? প্রধান আকর্ষণ কী কী?
বিশ্ব পর্যটনের বিস্তৃত পরিমণ্ডলে এক টুকরো বাংলাদেশ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত হিসেবে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এটি শুধু বাংলাদেশ নয় বরং পৃথিবীর অসংখ্য সমুদ্র প্রেমীদের প্রিয় গন্তব্যস্থল। শুধু বঙ্গোপসাগরের প্যানোরামাকে চোখে ধারণ করেই কাটিয়ে দেওয়া যায় পুরো একটি বিকেল। এমন প্রশান্ত দৃশ্যকল্পের সবটুকুই দৃষ্টিগোচর হয় ইনানী সৈকতে। কক্সবাজারের দীর্ঘ সৈকতেরই এই অংশ দর্শনার্থীদের দেয় প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটানোর অভাবনীয় সুযোগ। চলুন, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান কক্সবাজার ইনানী বীচে ভ্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় সবিস্তারে জেনে নেওয়া যাক।
ইনানী সমুদ্রসৈকতের অবস্থান
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের জেলা কক্সবাজারের অন্তর্গত উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত সৈকত ইনানী। কক্সবাজার সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণের এই প্রবাল সৈকতটিতে পৌঁছাতে হিমছড়ি ছাড়িয়ে আরও ১৫ কিলোমিটার যেতে হবে।
১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের আরও একটি নাম পাথুরে সৈকত। বিংশ শতকের একদম শেষ দিকে ধীরে ধীরে এটি পর্যটকদের নজরে আসতে শুরু করে।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার ইনানী সমুদ্রসৈকত যাওয়ার উপায়
বাসযাত্রার ক্ষেত্রে সরাসরি কক্সবাজারের বাস পাওয়া যাবে ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল অথবা কলাবাগান থেকে। বাস কোম্পানি এবং ধরণ (এসি/নন-এসি) ভেদে প্রতি জনের জন্য ভাড়া পড়তে পারে ৯০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে কক্সবাজার যেতে সময় লাগতে পারে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা।
যারা ট্রেনে যেতে ইচ্ছুক তাদের বিমানবন্দর বা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে কক্সবাজারের ট্রেন ধরতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সিটে যাত্রীপ্রতি ভাড়া পড়বে ন্যূনতম ৬৯৫ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩৮০ টাকা। রেলপথে কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে প্রায় ৯ ঘণ্টা সময় লাগবে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সরাসরি বিমানও রয়েছে, যেগুলো গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় নেয় মাত্র ১ ঘণ্টা।
কক্সবাজার থেকে ইনানী যেতে হয় মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে। এর জন্য চাঁদের গাড়ি, ছাদ খোলা জিপ, ট্যুরিস্ট জিপ ও মাইক্রোবাসের মতো বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় পরিবহন রয়েছে। এগুলো সবই সুগন্ধা পয়েন্টে ভিড় করে থাকে। ১০ থেকে ১২ জনের বড় গ্রুপ হলে ইনানী যাওয়ার জন্য পুরো একটি চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে খরচ হতে পারে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটানা ভ্রমণে ইনানী বিচ পর্যন্ত যেয়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে ঘুরে আসা সম্ভব।
এ ছাড়া রয়েছে অ্যাকোয়াহলিক ট্যুরিস্ট ক্যারাভান নামে ছাদ খোলা ডাবল ডেকার বাস। শুধু মেরিন ড্রাইভে যাতায়াতের উদ্দেশ্যে বানানো এই পরিবহনে করে বেশ আরামদায়কভাবে ইনানী পর্যন্ত যাওয়া যায়।
ইনানী সৈকতের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ
৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে সর্বাধিক সুন্দর দর্শনীয় স্থান হচ্ছে ইনানী বিচ। এখানকার বিশেষত্ব হচ্ছে ভাটার সময় সৈকত জুড়ে প্রবাল পাথর এবং শান্ত সাগর। জোয়ারের সময় এই পাথরগুলো পানিতে তলিয়ে যায়। পাথরগুলোর সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকে ধারালো ঝিনুক আর শামুক।
এখানকার শান্ত পরিবেশে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আর কোনো সৈকতে পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য এখানে নানান ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে।
সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বালুকাময় তীর ধরে ঘোড়ায় চড়া সঙ্গে দক্ষ গাইড থাকায় নতুন বা অভিজ্ঞ যেকোনো রাইডারের জন্যই এই অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
এর থেকে আনন্দটা আরও একধাপ বেড়ে যায় জেট স্কিইং-এর সময়। কেননা এখানে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরে ছুটে বেড়ানোর দুঃসাহস আর রোমাঞ্চের উত্তেজনা। সাধারণত স্কিইং করার সময় জেটে রাইডারের সঙ্গে একজন দক্ষ প্রশিক্ষক থাকেন। তবে দর্শনার্থীদের যারা অভিজ্ঞ তারা একা একাও স্কিইং করতে পারেন।
ইনানী পর্যন্ত যাওয়ার সময়টাও বেশ চিত্তাকর্ষক। কেননা যাত্রাপথে একে একে পেরিয়ে যায় হিমছড়ি পাহাড়,পথের ধারে সাম্পান নৌকা আর নারিকেল বা ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে দীর্ঘতম উপকূলরেখার দৃশ্য।
ইনানী সৈকত ভ্রমণের সেরা সময়
নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত আকাশ পরিষ্কার এবং রৌদ্রোজ্জ্বল থাকায় এই মৌসুম ইনানী ঘুরতে যাওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট সময়। ভারি বৃষ্টিপাত বা ঝড়ের আশঙ্কা না থাকায় রৌদ্র ও সমুদ্রস্নান এবং জেট স্কিইংয়ের জন্য এই আবহাওয়াটি সবচেয়ে উপযুক্ত।
এই অনুকূল আবহাওয়ার জন্য বিশেষত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। অবকাশ যাপনের বিভিন্ন সেবা বিশেষ করে হোটেল ভাড়া থাকে সবচেয়ে বেশি।
তাই বাজেট ভ্রমণপিপাসুরা আরামদায়ক উষ্ণতার পাশাপাশি কম খরচে ভ্রমণ করতে বেছে নিতে পারেন নভেম্বরের শেষ বা মার্চের প্রথম দিকটা। এখানে খেয়াল রাখতে হবে যে, বিকেলের দিকে জোয়ারের কারণে পিক টাইমেও মানুষের ভিড় হাল্কা থাকে।
অপরদিকে, প্রবাল দেখার জন্য ভাটা পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয় আছে। তাই ইনানী ভ্রমণের জন্য নিদেনপক্ষে একটি দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে আসা উচিত। এতে ভোরে সূর্যোদয় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখারও সুযোগ থাকে।
ইনানী সৈকত ভ্রমণে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
অন-সিজনে যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আগে থেকে হোটেল বুকিং দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে অফ সিজনে সরাসরি কক্সবাজারে গিয়ে দরদাম করে রুম ভাড়া নেওয়া যায়। ইনানীর আশপাশে কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে। তবে কম দামে থাকতে হলে কলাতলি থেকে আরও ভেতরের দিকে যেতে হবে। মূলত সৈকত থেকে যত দূরে তথা শহরের যত ভেতরে যাওয়া যায় কম ভাড়ায় রুম পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়ে। মান ভেদে বিভিন্ন হোটেলের রুম ভাড়া গড়পড়তায় মাথাপিছু ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা হয়ে থাকে।
তবে পরিবার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে হলে ভালো উপায় হচ্ছে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া। রান্নাঘরসহ বেড রুম বিশিষ্ট ফ্ল্যাট ভাড়া পড়তে পারে দিনপ্রতি ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্যটনকেন্দ্র হওয়ায় আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি এখানে যথেষ্ট পরিমাণে খাবার হোটেল,রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট রয়েছে। এগুলোতে শুধু খাবারের পদেই নয় বৈচিত্র্য রয়েছে মান ও মূল্যেও।
উপকূলবর্তী এলাকা বলে এখানে পর্যটকদের জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে সামুদ্রিক খাবার। নিত্য-নৈমিত্তিক সাদা ভাতের সঙ্গে থাকে ভাজা মাছ ও চিংড়ির তরকারি। এগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় নিজস্ব রন্ধন ও পরিবেশন শৈলী অনুযায়ী। তন্মধ্যে সর্বাধিক মুখরোচক খাবারের মধ্যে রয়েছে নারকেল চিংড়ি। এতে নারকেলের গুড়ো চিংড়ির সঙ্গে একত্রে ভাজা হয়।
আরেকটি খাবার হচ্ছে গ্রিল্ড পমফ্রেট,যেখানে তাজা পমফ্রেট পর্যাপ্ত মশলা মিশিয়ে গ্রিল করা হয়। এছাড়াও সর্বাধিক বিক্রি হওয়া খাবারের তালিকায় থাকে ইলিশ ভাজা এবং কাঁকড়া।
কক্সবাজার ইনানী বীচ ভ্রমণকালীন কিছু সতর্কতা
– ইনানী যাওয়ার পথে সেনাবাহিনীর কয়েকটি চেকপোস্ট পড়ে, বিধায় আগে থেকেই সঙ্গে জাতীয় ও পেশাগত পরিচয়পত্র রাখতে হবে।
– হোটেল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কখনোই স্থানীয় পরিবহন চালকদের পরামর্শ নেওয়া বা কোনো দালালের স্মরণাপন্ন হওয়া সমীচীন নয়।
– ফেব্রুয়ারি বা মার্চে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য দিনগুলোতে গেলে ভ্রমণ খরচ যথেষ্ট কমানো যাবে।
– সাগরে সাঁতার বা গোসলের জন্য জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে স্থানীয় নিরাপত্তা নির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ডগুলো অনুসরণ করা এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
– সৈকতে যেখানে সেখানে খাবারের উচ্ছিষ্ট মোড়ক বা অন্যান্য ময়লা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সবশেষ, ইনানী সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ মানে শহরের যান্ত্রিকতা ও অস্থিরতা থেকে বের হয়ে এক শান্ত জগতে প্রবেশ। ২১ শতকের শুরুর দিকের এই উদীয়মান পর্যটনকেন্দ্রটি এখন যথেষ্ট পরিণত হয়েছে। ভাটার সময় প্রবালের দিকে শত শত পর্যটকের বিমোহিত দৃষ্টিগুলো তারই প্রমাণ। এই নিশ্চুপ নৈসর্গের মাঝে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার জন্য অন্তত একটি রাত কক্সবাজার ইনানী বীচের আশপাশে থেকে যাওয়া উচিত। দুর্লভ এই সুযোগটি সারা জীবনের জন্য চির স্মরণীয় করে রাখতে পারে ইনানীতে কাটানো একটি শীতের গোধূলি কিংবা ভোরকে।