যেমন দেখে এলাম ওয়াহেদ ম্যানশন
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন। এটি এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত নাম। বড় কোনো অর্জন নয়, এক মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনায় এই ভবন স্থান করে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী।
২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে ওয়াহেদ ম্যানশন। আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছে ৬৭ তাজা প্রাণ। হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরো অর্ধশতাধিক মানুষ। যার শোকে স্তব্ধ গোটা দেশ। শুক্রবার সকাল থেকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশন ঘুরে দেখা যায় আগুনের ভয়াবহতা।
শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টা। ওয়াহেদ ম্যানশনের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে কাজ করছেন সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। আগুনে পোড়া ভবনের আশপাশের রাস্তায় এলাকাবাসী ও উৎসুক মানুষের ভিড়। তবে প্রশাসনের কড়াকড়িতে তারা ওয়াহেদ ম্যানশনের কাছে ঘেঁষতে পারেননি। আর তাই দূর থেকে তাকিয়ে দেখছেন আগুনে পুড়ে বহু মৃত মানুষের জ্বলে যাওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকা ভবনটি।
এরই মধ্যে সকাল থেকে ওয়াহেদ ম্যানশন ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসে সিটি করপোরেশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল। তাঁরা ভবনের আশপাশ ঘুরে দেখেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদক ওয়াহেদ ম্যানশনের পশ্চিমমুখের গলি দিয়ে দক্ষিণমুখী ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন। তবে আরেকটি ছোট প্রবেশদ্বার আছে পশ্চিমমুখী। যেটি দিয়ে ওয়াজেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় থাকা সুগন্ধির গুদামে যাওয়া যায়, যেখানে মজুদ করে রাখা সুগন্ধিগুলো রিফিল করা হতো।
ভবনটির নিচতলার একটি গুদামে এখনো প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ অক্ষত অবস্থায় মজুদ রয়েছে। ম্যানশনের যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে পোড়া জিনিসপত্র। বিভিন্ন প্রসাধনীর কৌটা, বৈদ্যুতিক বাতি, নানান রকম বড় বড় কার্টন, ঘরের আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল। কিন্তু এগুলো এখন শুধুই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের ভয়াবহতাকে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এসব জিনিস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এখনই সময় শিক্ষা নেওয়ার। নিজেদের আবাসস্থলকে নিরাপদ করার। না হলে একটু অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে শত প্রাণ।
ওয়াহেদ ম্যানশনের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে, আগুনে পুড়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এরপর গেট পেরিয়ে একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে কার পার্কিংয়ে রাখা একটি এলিয়েন প্রাইভেটকার। গাড়ি ঢেকে রাখার কাভার দিয়ে সযত্নে রাখা গাড়িটি পড়ে আছে পার্কিংয়ে। নেই শুধু ব্যবহারকারীদের হাতের ছোঁয়া। এর পর ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই চোখে পড়ল, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আগুনে পোড়া অনেক জিনিস। যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বৈদ্যুতিক বাল্ব, সুগন্ধির কৌটা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও ঘরের আসবাব।
সিঁড়িতে পড়ে থাকা এসব জিনিসপত্র ডিঙিয়ে একটু সামনে এগোলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দোতলায় উঠতে চোখে পড়ে একটি ড্রয়িংরুম। যেখানে এখনো পড়ে আছে সাজানো সোফা সেট, শোকেস। তবে এগুলো এখন আগুনে পোড়ার সাক্ষী। এসব জিনিসপত্রও হয়তো কাজে লাগাবে আগুনের ঘটনা খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত দল। এ ছাড়া আর কোনো কাজে আসবে না এসব আসবাবপত্র।
ড্রয়িংরুম থেকে বের হতেই চোখ যায় খাবার ঘরের দিকে। রুমে যেতেই চোখে পড়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজানো প্লেট, রান্না করা খাবার রাখা পাতিল, চামচ, পানির মগ, গ্লাস। কিন্তু নেই শুধু এ টেবিলে প্রতিদিন খাওয়া মানুষগুলো। ড্রয়িং, ডাইনিং রুম থেকে সামনে এগোলেই দেখা যায় আরো কয়েকটি রুম। কিন্তু এসব রুমে কখনো কোনো মানুষের অস্তিত্ব ছিল, সেটি দেখে বোঝার উপায় নেই। আগুনের ভয়াবহতায় সব পুড়ে একাকার। দ্বিতীয় তলার সবকটি রুমেই একই অবস্থা।
এসব রুম থেকে বের হতেই চোখে পড়ে বিভিন্ন কোম্পানির সুগন্ধির খালি বোতল, বৈদ্যুতিক বাতি। যেগুলো নষ্ট ও খালি হয়ে যাওয়ার পর এখানে মজুদ করে মেরামত ও রিফিল করা হতো। অগ্নিকাণ্ডের পর এসব জিনিস আগুনের তীব্রতাকে আরো ভয়াবহ রূপ ধারণে সহায়তা করে।
দ্বিতীয় তলা থেকে বেরিয়ে ভবনের তৃতীয় তলায় উঠতে চোখে পড়ে আগুনের আরো নির্মমতা। এখানেও আছে খাবার টেবিল, রান্নাঘর, বুকশেলফ, দামি দামি সব সোফাসেট। কিন্তু এগুলো ব্যবহারের উপযোগিতা নেই, নেই ব্যবহারকারী কোনো মানুষ।
তৃতীয় তলায় এসব রুম ঘুরে অন্য রুমে প্রবেশ করলে দ্বিতীয় তলার অবস্থাই দেখা যায়। তবে ভয়াবহতা প্রথম ও দ্বিতীয় তলা থেকে অনেক বেশি। এখানেও বিভিন্ন সুগন্ধি, বৈদ্যুতিক বাল্ব, বিদেশি তেলের বোতলসহ বিভিন্ন প্রসাধনী আগুনে পুড়ে কালো।
সব শেষ ভবনের ওপরের তলা, অর্থাৎ চতুর্থ তলা গেলে দেখা মেলে, শুধু সুগন্ধির হাজার হাজার আগুনে পোড়া কৌটা পড়ে আছে। এ ছাড়া ভবনে থাকা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, সিলিং ফ্যান পুড়ে আগুনের ভয়াবহতার নিদর্শনস্বরূপ টিকে আছে, যা দেখলেই যে কেউ অনুমান করতে পারবে কতটা ভয়াবহতা ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের আগুন। কতটা কষ্টে ছটফট করে মানুষগুলো নিজের জীবন দিয়েছেন।
সব শেষ ওয়াহেদ ম্যানশনের পশ্চিমমুখী সরু গেট দিয়ে দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করেন এ প্রতিবেদক। যেখানে পুরোটাই জুড়ে ছিল সুগন্ধি, বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির তেলের বোতলের মজুদ। এখানে এসব সুগন্ধি, তেল নতুন করে রিফিল করে এগুলো বাজারে সরবরাহ করা হতো। যার ফলে ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনের ভয়াবহতা তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে থাকা ভবন ও দোকানপাটে। এই আগুনে কেড়ে নেয় নিরীহ ৬৭ জন মানুষের তাজা প্রাণ। এ ছাড়া নষ্ট হয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক বাতি পড়ে ছিল আরো বড় বড় দুটি রুমে। এসব নষ্ট বাতি মজুদ করে মেরামত করা হতো। পরে এসব মেরামত করা বাতিগুলো বাজারে সরবরাহ করা হতো।