ট্রেন গেলে ব্রিজ কাঁপে, নাট-বল্টু নেই, বললেও কেউ শোনেনি
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলওয়ে স্টেশনের কাছে যে সেতুটি ভেঙে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, সেই সেতুটির দুরবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
গতকাল রোববার গভীর রাতে ট্রেনটির ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাহাড়ি ছড়ার মধ্যে পড়ে চারজন নিহত হন, আহত হন অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী। এ সময় রেললাইনটি দুমড়েমুচড়ে যায়। ঘটনার পর থেকেই সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
দুর্ঘটনার পর পরই প্রথমে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং উদ্ধারকাজ শুরু করেন। তাঁরাই পুলিশ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে খবর দেন। রাতের বেলায় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। নিজেদের বাড়ি থেকে লাইট এনে অনেককে উদ্ধারকাজে তৎপর হতে দেখা যায়।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় বরমচাল রেলওয়ে স্টেশনের কাছে গতকাল রাতে ট্রেন দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে আসা রেললাইনের পাশের গ্রাম নন্দনগরের বাসিন্দা ফারুক মিয়া (৪৫) এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলছেন। ছবি : এনটিভি
স্থানীয়রা মনে করছেন, একে তো সেতুটি অনেক আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তার ওপরে ট্রেনটির গতিও ছিল বেশ। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরাইলের শাহবাজপুরে বেইলি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় ঢাকা-সিলেট সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে। এ কারণে গতকাল রাতে ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল। অন্য সময় ট্রেনটি ১৫টি বগি নিয়ে যাতায়াত করলেও গতকাল ট্রেনটিতে ১৭টি বগি ছিল।
উদ্ধারকাজে আসা রেললাইনের পাশের গ্রাম নন্দনগরের বাসিন্দা ফারুক মিয়া (৪৫) এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ব্রিজের সাইডে পাত দুইডা লাগানো থাকে, জোড়ার মধ্যে। এর এদিকে একটি নাট, ওদিকে আরেকটি নাট। আর কোনো নাট নাই। গাড়ি যখন যায়, তখন খালি কাঁপে, ঝিলকা মারে। প্রায় সময়ই আমরা রেলের মানুষকে বলছি। এখানে একটা সমস্যা ঘটবে। আপনারা দয়া করে দেখেন, সমস্যাটা কী। এখনো আছে। এখান থেকেই সমস্যাটার শুরু হইছে।’
‘রাতে যখন ট্রেনটি যায়, তখন অন্যদিনের চেয়ে কালকে গতিও একটু বেশি মনে হইছে। ব্রিজটার যেহেতু সমস্যা আছে, একটু অস্তে যাওয়া উচিত ছিল,’ বলেন একই গ্রামের নুরুল আমিন চৌধুরী। তিনিও দুর্ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধারকাজে অংশ নেন।
দুর্ঘটনাস্থলের পাশের মহলাল এলাকার বাসিন্দা পারভেজ বলেন, ‘কাল রাতে ট্রেনটিতে প্রচুর যাত্রী ছিল। অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আমরা উদ্ধার করতে এসে মানুষের কান্না আর চিৎকার শুনেছি।’
মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি গতকাল রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে উপজেলার বরমচাল স্টেশন থেকে ২০০ মিটার দূরে ইসলামাবাদ এলাকায় পৌঁছালে পেছন দিকের বগিতে বিকট শব্দ হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সামনে বড়ছড়া ব্রিজ ভেঙে একটি বগি পড়ে যায়। আরো তিনটি বগি ব্রিজের পাশে উল্টে দুমড়েমুচড়ে যায়। এ ছাড়া অন্য দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়।’
কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার দুলাল চন্দ্র দাস সোমবার সকাল ৭টার দিকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছেনি। বগির উদ্ধারকাজ ও সেতু মেরামতের কাজ শেষ হলে এই পথে পুনরায় রেল চলাচল স্বাভাবিক হবে।’
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, যে জায়গাটিতে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখান থেকে মৌলভীবাজার যেতে বেশ সময় লাগে। তার চেয়ে বরং সিলেটে যোগাযোগ অনেক সহজ। এ কারণেই অধিকাংশ আহতদের সিলেট পাঠানো হচ্ছে।
স্থানীয় মোহাম্মদ জাহির আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দ হয়। আমরা তখন বাড়ি থেকে দৌড়ে আসি। দুর্ঘটনা দেখে আমি কুলাউড়া ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিই। পাঁচবার ফোন হওয়ার পরে ধরে। তারপর তারা বলে, সিলেটে ফোন দেওয়ার জন্য। আমরা তখন নাম্বার জোগাড় করে সিলেটে ও রেলে ফোন দিই। প্রায় দুইশজনের মতো মানুষের হাত-মাথা ফাটছে। এক ঘণ্টা পর কুলাউড়া ফায়ার সার্ভিস আর দেড় ঘণ্টা পর সিলেট ফায়ার সার্ভিস আসছে।’