সত্যের মতো ভাস্বর তিনি
সত্য সত্যেরই মতো ভাস্বর থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না থেকেও তেমনি আছেন আমাদের মাঝে। বলা হয়, মঙ্গল সাধনের সিদ্ধান্ত সমাজের ওপর আরোপ করলেই নেতা হওয়া যায় না। সমাজকে ব্যবহার করেই সমাজের উন্নতি সাধন করতে হয়। তিনিই নেতা, যিনি সমাজের মঙ্গলের নিমিত্তে অনেকটা এগিয়ে ভাবেন এবং তা প্রয়োগ করেন।
বছর ঘুরে স্বাভাবিক নিয়মে ১৫ আগস্ট এলে জাতীয় শোক দিবসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করে বাঙালি।
আজ কত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী দেশজুড়ে! কারণ, তাঁর কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। কিন্তু সেই রাজনীতি কোথায়, যা বঙ্গবন্ধু করতেন? কেমন রাজনীতি করতেন জাতির জনক? তাঁর রাজনীতি ছিল বিপরীত পথের মানুষকেও এক জায়গায় আনার, একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকার।
জাতি হিসেবে এমন বড় রাজনীতিককে গ্রহণের যোগ্যতা ছিল না আমাদের। আমরা এতটাই ক্ষুদ্র যে, এমন এক মানুষকেও সপরিবারে খুন করতে পেরেছি। ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত। সে সময় দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বাঙালির জীবনে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সেই প্রতীক, যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না। ওই অন্ধকার দিনগুলোতে, ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি মানুষ, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক’, কথাগুলো বলেছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ‘মোজাফফর আহমদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা ১৯৮০, বাংলাদেশ জাতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধে।
লোক দেখানোভাবে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ ভাবমূর্তি রচনা করতে চায় একশ্রেণির রাজনীতিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে জনগণই আপন করে নিয়েছিল। একজন সাধারণ কর্মী থেকে নেতা হন। দলের নির্দেশনা মেনেছেন, রাজপথে থেকেছেন, জেল-জুলুম সয়েছেন এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি সততা, নিষ্ঠা আর মানুষের জন্য ভালোবাসার প্রমাণ রেখেছেন। আর এ কারণেই কতিপয় উগ্রবাদী ছাড়া তাঁর রাজনীতির সমর্থক নয়, তাঁরাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সমীহ করে কথা বলেছেন।
‘বাংলাদেশ : এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের আবির্ভাব বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। শেখ মুজিবের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি রূপকথার নায়কের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকবেন। হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ মুজিবের চেয়েও প্রজ্ঞাবান, দক্ষ, সুযোগ্য ও গতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় ঘটেছে বা ঘটবে, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় পরিচিতি নির্ধারণে তাঁর চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন এমন কাউকে পাওয়া কঠিন হবে।’
সাহিত্যিক আহমদ ছফা ১৯৯৪ সালে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে চট্টগ্রাম বিজয়মেলার স্মারক গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘আজ থেকে অনেক দিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রুপালি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ভাবধারায়। প্রশাসন থেকে রাজনীতি, সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনি জয় বাংলার বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে সদম্ভে বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, তাঁদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছে মৃত মুজিব ছিলেন ভয়াবহ আতঙ্কের। বিভিন্নভাবে তাঁরা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেওয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, নির্বাসনে পাঠানো হয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে, ছুড়ে ফেলা হয় উদারতার সব আয়োজন, ফিরিয়ে আনা হয় পাকিস্তানি ধর্মীয় উগ্রবাদকে।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কালো অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছে, লালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের রাজনীতি। কিশোর বয়স থেকেই সাহসী মুজিব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তাঁর রাজনৈতিক গুরুদের জানান দিয়েছিলেন, এই মাটিতে শুধু নন, বিশ্বদরবারে তিনি হয়ে উঠছেন বড় রাজনীতির প্রতীক।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালির পরাজয়। বঙ্গবন্ধু এই জাতির কাছে কিছু চাননি কখনো। দুঃখজনক হলো, আজ বাঙালির অনেকেই তাঁর প্রতি ভক্তির প্রাবল্য দেখায়, কিন্তু তাঁরা তাঁর যে নীতি ছিল, সেই রাজনীতির চেষ্টা করেন না।
লেখক : সাংবাদিক