বিশ্ব পর্যটন দিবস
বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনা ও কিছু কথা
কবি বিশ্বাস করেই বলেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। প্রকৃতির কন্যা এই সুশোভিত দেশের আতিথ্য গ্রহণ করে মনপ্রাণ জুড়িয়েছেন হাজার বছরের বেশুমার পর্যটক। আর এখন নাতিশীতোষ্ণ এই দেশটার টানে কাঙ্খিতমাত্রায় পর্যটক ভিড় করে না। ফি বছর পর্যটন দিবস আসে, আমরা নিয়ম মেনে খানিকটা হৈচৈ করি, আবার ফিরে যাই আগের সেই স্থবিরতায়।
অথচ আমাদের আছে বিশ্বের সবচে` বড় সমুদ্র সৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সেন্ট মার্টিনের মতো কোরাল আইল্যান্ড। কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতের মতো একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্য আর ক’টা দেশে গেলে দেখা মেলে? বান্দরবানের মতো পাহাড়ি জনপদ। যেখানে উপচে পড়া সৌন্দর্যরা সারা বছরই আমাদের মন ভরায়। সেখানকার নীলগিরি, নীলাচল, খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালি মন ভোলায় না কার? সমুদ্র, পাহাড়, নদ-নদী, বনাঞ্চল বা সবুজ গ্রামের একীভূত রূপ আর কোথায় আছে? জাফলং-বিছানাকান্দির জল পাথরের মিতালি কার না দেখতে ভালো লাগে? এমন রূপের আবেদন আমরা হেলায় হারাচ্ছি। বিশ্বসমাজকে জানাতেই পারছি না, আমাদেরও আছে দেখ সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য। শিলং কিংবা দার্জিলিংয়ের রূপলহরী এই বাংলাদেশেও আছে। আমাদেরও আছে হাজার বছর আগের প্রত্ন ঐতিহ্য ।
বিশ্বে এমন অনেক দেশই আছে শুধু পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে যাদের অর্থনীতির ভিত। সেসব দেশে পর্যটন খাত লাভজনক শিল্প। তেমনি ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন খাতের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে কিছু কাজ হলেও এখনো সরকারি পর্যায়ে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গড়ে তোলা যায়নি উপযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান। নেওয়া হয়নি পর্যটকবান্ধব কোনো নীতিমালা। গ্রহণ করা হয়নি ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য আকর্ষণীয় ও নিরাপদ কোনো কর্মপরিকল্পনা।
দেশে টুরিজম বোর্ড এবং পর্যটন করপোরেশন নামে সরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের সেবা সম্পর্কে জনসাধারণের নেই কোনো স্পষ্ট ধারণা। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবপেজগুলোও নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। নিয়মিত মেইনটেইন করা হয় না ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউব আইডি। অথচ এই সময় বিদেশে নিজেদের পর্যটন আকর্ষণকে লোকসমাজে জনপ্রিয় করতে রেডিও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ায়ও আপডেট করা হয়।
বাংলাদেশে ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানোর কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে। কিন্তু শুরু থেকেই এক ধরনের স্থবির অবস্থা দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়া ও ওয়েবসাইটে। এরইমধ্যে ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেয় সরকার।পর্যটন বর্ষ-২০১৬ সফল করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) প্রচারণার জন্য যে কয়টি কার্যক্রম হাতে নেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সোশ্যাল মিডিয়া প্রমোশন’। বিস্ময়কর হলেও সত্য ডিজিটাল বাংলাদেশে তেমন প্রমোশন কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। আর এভাবেই কোনোরকম উল্লেখযোগ্য অর্জন ছাড়াই সরকার ঘোষিত ওই পর্যটন বর্ষটি সমাপ্ত হয়েছে। যদিও এ বছর ও আগামী বছরও ওই ঘোষণাবর্ষের কার্যকারিতা থাকবে বলে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। কার্যত দেশে সরকারি পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্রমোশন নামে আছে কাজে নেই। তবে বেসরকারি পর্যায়ে গ্রান্ড সুলতানের মতো উচ্চমানের রিসোর্টগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ক্যাম্পেইন চালালেও তাও খুব বেশি জনপ্রিয় নয়।
পর্যটন বর্ষ উপলক্ষে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ, ক্যাম্পেইন ও গুটিকয়েক রোড শো ছাড়া টুরিজম বোর্ড তেমন কিছু করেনি। যথার্থ পরিকল্পনাবিহীন এসব কর্মকাণ্ড এমন কোনো প্রভাব ফেলেনি যাতে বাংলাদেশের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াবে বা এই খাতের চলমান মন্দা দূর হবে।
অথচ বর্তমানে বিশ্বব্যাপীই ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নানামুখী প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। জার্মান সংবাদমাধ্যম ‘ডয়েসে ভেলে’ জানাচ্ছে, কোথায় ছুটি কাটাতে যাবেন এবং কত দামে, তা ঠিক করতে অধিকাংশ মানুষ সবার আগে যান সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে৷ শেষে বুকিং হয়তো করলেন ট্র্যাভেল এজেন্সিতে, কিন্তু গোড়ার খোঁজখবর সবই চলে অনলাইনে৷ সর্বাধুনিক জরিপে বলে, আশি শতাংশ জার্মানের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য৷ ইন্টারনেটে ব্লগাররা নানা চেনা-অচেনা গন্তব্য সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়ন জানান৷ অন্যান্য পোর্টালে বিভিন্ন হোটেলের ভালো-মন্দ নিয়ে মন্তব্য ও পরামর্শ থাকে; ফেসবুকে বন্ধু-বান্ধবরা যদি তাঁদের শেষ ছুটি কাটানোর ছবি সেঁটে দিয়ে থাকেন, তবে সেই সব ছবি দেখে তা থেকে নতুন কোনো গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে৷ ফেসবুক ঘাঁটা পর্যটন কোম্পানিগুলোর ক্যাটালগ ঘাঁটার চেয়ে যে অনেক বেশি ভালো, অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, তা সবাইই স্বীকার করবেন৷
কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলো এখনো সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেনি। আমাদের টুরিজম বোর্ড বা পর্যটন করপোরেশনের ফেসবুক পেইজ চালু আছে, কিন্তু ভ্রমণপিয়াসীরা কেন সেখানে ‘ঢু’ মারবার প্রয়োজন বোধ করেন না, তা ভাবার সময় এখনই। পর্যটন দিবস আসলে ঘটা করে শোভাযাত্রা বা রোড শো করেই ক্ষান্ত দিলে পর্যটন খাতের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাবে না।
দেশের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে ১৯৯২ সালে প্রথম জাতীয় পর্যটন নীতিমালা করা হয়। এতে বলা হয়েছিল, বিদেশি পর্যটকদের আধুনিক ও চিত্তবিনোদনের সব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হবে। কক্সবাজার ও সুন্দরবনের জন্য নেওয়া হবে মহাপরিকল্পনা। পর্যটন খাত বিকাশে বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। কিন্তু এই কথাগুলোও এখনো কিতাবেই আছে। আর যথারীতি এখনো বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশের পর্যটন সক্ষমতা তলানিতেই আছে। অথচ বাংলাদেশের সম্ভাবনা ছিল বিশ্বের দেড়শো কোটি পর্যটকের বড় অংশের গন্তব্য হওয়ার। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিল(ডব্লিউটিটিসি) তাদের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনেই বলে রেখেছিল বিশ্বের যে ২০টি দেশ পর্যটন খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি করবে, তার একটি বাংলাদেশ।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী গেল আট বছরে পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিবেচনায় যথার্থ উদ্যোগ থাকলে এক বছরেই এ টাকা উপার্জন সম্ভব। উপরন্তু প্রতিবছর হাজারো বাংলাদেশি পরিব্রাজক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ভারত, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর,মালদ্বীপ বা ইন্দোনেশিয়ায় বেড়াতে যান যাদের অনেকেরই সুন্দর বাংলাদেশটা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি।
সম্প্রতি ইউরোপের সবচে গোছানো শহর নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডামে পর্যটক আসা নিরুৎসাহিত করতে নতুন কিছু নীতিমালা গ্রহণ করেছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ। প্রতিবছর ওই শহর পরিদর্শনে যায় ১৭ মিলিয়ন পর্যটক। শহরবাসী এই পর্যটকের ভার আর নিতে পারছেন না। পক্ষান্তরে আমরা পর্যটক আকৃষ্ট করবার মতো কর্মপন্থাই এখনো নির্ধারণ করে উঠতে পারছি না। আমরা একটু সচেতন হলেই নিজেদের পর্যটন সক্ষমতা বাড়িয়ে বিপুলসংখ্যক বিদেশি দর্শনার্থীকে নিজের দেশে আনতে পারতাম। আধুনিক জেনারেশনের চাওয়াকে মাথায় রেখে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যবহার করে আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হতে পারতাম। অপরূপ বাংলাদেশটাকেও বিশ্বমানুষ তাদের অবকাশযাপনের ঠিকানা হিসেবে ভাবতেন, যদি আমরা মেধাবী ও যোগ্য মানুষদের ঠিক জায়গায় বসাতে পারতাম।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন

ফারদিন ফেরদৌস