অভিমত
সৃজনশীল শিক্ষার হতাশাজনক চিত্র
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী ছিলাম। কারণ, কচিকাঁচা ছেলেমেয়েদের অন্তত মুখস্থ নামক একটা আপদের হাত থেকে মুক্ত করা গেছে ভেবে আমার ভেতরে তীব্র আনন্দ বয়ে গিয়েছিল।
এমনটি ভেবে মনে মনে দুঃখও পেয়েছিলাম যে কেন এমন একটা সময়ে আমি পড়ালেখার সুযোগ পেলাম না। কারণ বেশি বেশি মুখস্থ আর অল্প স্বল্প বুঝেই দিব্যি ভালো রেজাল্ট করা যেত। ফলে কপালে ভালো ছাত্রের তকমা জুটে যেতেও সময় লাগত না। সৃজনশীলতা বলে তেমন কোনো বিষয়ই ছিল না।
তাই যখন মুখস্থ বিদ্যাকে ছুটি দিতে সৃজনশীল পাঠ পদ্ধতি চালু হলো, তখন সত্যি সত্যি আমার দারুণ ভালো লেগেছে। কারণ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আর কষ্ট করে কোনো কিছু মুখস্থ করতে হবে না; তারা শুধু বিষয়টা বুঝে নিয়ে নিজের মতো করে প্রশ্নের উত্তর লিখলেই হবে। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির ফলে গাইড বই মুখস্থ এবং কোচিং সেন্টারের হাত থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রেহাই পাবে। তারা সে সময়ে খেলাধুলা বা অন্য কোনো সামাজিক কাজে সময় দিতে পারবে। কী দারুণ ব্যাপার হবে সেটা। এটা ভাবতেই একটা অপার্থিব সুখ অনুভব করেছিলাম।
কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস আর অধিকাংশ শিক্ষকের যথাযথ যোগ্যতার অভাবে সৃজনশীল সে পদ্ধতি মাঠে মারা গেছে। সম্মানিত শিক্ষকদের অযোগ্যতার কথা বলায় আমাকে ভুল বুঝবেন না। কারণ এটা মাউশির গবেষণাতেই উঠে এসেছে।
আমিও মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। ফলে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে এ পেশার মানুষদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার বিন্দুমাত্র কমতি নেই। কোনোদিন কমতি ছিলও না। তবে সম্প্রতি সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতির দৈন্যদশার জন্য শিক্ষকদের অযোগ্যতার বিষয়টা আবার সামনে চলে এসেছে। যদিও এমন গবেষণাধর্মী ফলাফল বিগত বছরগুলোতেও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও দুঃখজনকভাবে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
মাউশির প্রতিবেদনেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের এমন অযোগ্যতার বিষয়টা উঠে এসেছে। সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গড়ে দেশের ৫২.০৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো সৃজনশীল অংশ বোঝেন না। এর মধ্যে ৩০.৮৯ শতাংশ শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন তৈরি করেন। আর সমিতি থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২১.১৭ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ আগস্ট, ২০১৭)।
২০১৬ সালে মাউশির প্রতিবেদনেও অনুরূপ তথ্য উঠে এসেছিল। বরং এবারের প্রতিবেদনে পরিস্থিতির উন্নতি তো নয়; বরং অবনতির চিত্রই ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের ৪৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। (সূত্র : প্রথম আলো, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬)
আবু রইস নামক একজন সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষকের লেখনীতেও এটা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি গত বছরই লিখেছেন, ‘সৃজনশীল পদ্ধতি সফল বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় সৃজনশীল শিক্ষকের অভাব। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা সৃজনশীল শব্দটির সুস্পষ্ট ধারণা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনেও সমর্থ নন। যিনি নিজে সৃজনশীল নন, তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতার বীজ বপন করবেন।’ (সূত্র : প্রথম আলো, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬)। সত্যিই বড্ড কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর তাই সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাই ভালো দিতে পারবেন।
২০০৮ সালে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার পর দীর্ঘ প্রায় আটটি বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে এসএসসিতে বাংলা ও ধর্ম বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ধীরে ধীরে সব বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত শুরু করে।
পুরোনো সিলেবাস বদলে নতুন ব্যবস্থা অর্থাৎ সৃজনশীল পদ্ধতি চালু যদি হয়, সফলতার শুরুর চিত্র তাহলে বলতেই হবে এতদিনে আমাদের অগ্রযাত্রা কাঙ্ক্ষিত রূপ এবং গতি কোনোটাই পায়নি। বরং নানা সময়ে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোচিং ব্যবসা তার দুরন্ত গতি অব্যাহত রাখতে পেরেছে। গাইড বইয়ে এখন বাজার আরো বেশি ছেয়ে গেছে। আর শ্রদ্ধেয় অনেক শিক্ষক এখন অবধি সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে পারলেন না—এটা সত্যিই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির এক নম্বর হতাশাব্যঞ্জক চিত্র।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকরা এ পদ্ধতি সম্পর্কে কেন এখনো বুঝতে পারছেন না? এর উত্তরে মূলত দুটো কারণকেই সাদা চোখে দৃশ্যমান বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এক. যথেষ্ট পরিমাণে এ পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না দেওয়া। আবার প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা বা দুর্বলতার কারণে যাঁরা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাঁরা তাঁদের সে জ্ঞানকে বাস্তবে আর কাজে লাগাতে পারছেন না। দুই. নতুন নতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয় যখন গ্রাম-গঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন সেখানে যে সমস্ত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা এখন নতুন এ পাঠপদ্ধতি সম্পর্কে যোগ্যতা এবং দক্ষতা অর্জনে সত্যি সত্যি হিমশিম খাচ্ছেন। এসব শিক্ষক সত্যিকারের বিচারে শিক্ষক হওয়ারই যোগ্য নন। যে শিক্ষক নিজেই সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ, তিনি তাহলে কীভাবে ছেলেমেয়েদের এ পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা দেবেন? এটা এমন একটা মৌলিক প্রশ্ন, যেটা সমাধান করার সূত্র খুঁজে পাওয়া বাস্তবে সত্যিই কঠিন।
বর্তমানে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সবাই এত ব্যস্ত যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এমন দুর্গতির চিত্র তাই হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু একসময় থিতু হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের জাতি গঠনের যে ক্ষেত্র, সেটা যদি এভাবে পিছিয়ে পড়ে তাহলে বলতে হবে আমাদের সামনে সর্বনাশা ভবিষ্যৎই হয়তো অপেক্ষা করছে। এ ক্ষতি সীমাহীন। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাই নিয়ত চেষ্টার প্রয়োজন। প্রয়োজন দক্ষতা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতা পেশার মতো মহান পেশায় যুক্ত করার মতো পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ। তাহলেই হয়তো এ মেঘ কেটে আলোকশিখা দৃশ্যমান হবে।
লেখক : চিকিৎসক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।

ডা. পলাশ বসু