রোহিঙ্গা সংকট
নাজুক পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, গৃহে অগ্নিসংযোগসহ পৈশাচিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে এ বছর সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা তাদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়েছে তাদের। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল- মানবিক সহায়তা-সহানুভূতি পেলেও কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা দিন দিন সহিংস হয়ে উঠছে। হত্যা, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও।
গত শনিবার সকালে কক্সবাজারের রামুর খুনিয়াপালং হেডম্যানপাড়ায় আবদুল জব্বার নামের স্থানীয় এক যুবককে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা যুবক হাফেজ জিয়াবুল মোস্তফা। পুলিশ এ ঘটনায় মোস্তফা এবং তার ফুফু ভেলুয়ারা বেগমকে আটক করেছে। নিহত জব্বার রামুর খুনিয়াপালংয়ের কালুয়ারখালীর হেডম্যান বশির আহম্মদের ছেলে।
এর আগে শুক্রবার রাতে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের হামলায় পাঁচ বাংলাদেশি গুরুতর আহত হন। একই রাতে ডাকাতির চেষ্টার ঘটনায় ১০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে পাঁচজনকে রোহিঙ্গারাই আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। পরে শনিবার অভিযান চালিয়ে আরো পাঁচজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়।
১৭ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের হামলায় উখিয়ার পালংখালী এলাকার মুরগির খামার মালিক জমির উদ্দিন আহত হন। এর আগের দিন উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গাদের হামলায় রোহিঙ্গা খুনের ঘটনা ঘটে। ৭ অক্টোবর কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা বস্তি লাগোয়া খাল থেকে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৮ অক্টোবর কুতুপালংয়ে ত্রাণের টোকেন বিতরণ করতে গিয়ে মুক্তি নামের এক এনজিওকর্মী রোহিঙ্গাদের কবল থেকে বাঁচতে গাছে ওঠে পড়েন। ১৯ অক্টোবর মহিষ বিক্রিকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোছনের ছেলে ধলাইয়া ও কালাইয়া স্থানীয় আবু ছিদ্দিককে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে।
পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ২১ অক্টোবর টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে রোহিঙ্গা নারী দিল বাহার ও তার স্বামী সৈয়দ আহমদ অবৈধভাবে একটি মুদির দোকান স্থাপন করার চেষ্টা করে। ক্যাম্পের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কবির আহমদ বাধা দিলে তার ওপর হামলা চালায় রোহিঙ্গা দম্পতি।
রোহিঙ্গারা যে শুধু হত্যা, চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তা নয়। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন রোগ বালাই নিয়ে বড় রকমের আতঙ্কে আতঙ্কিত এখন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে এ দেশে পালিয়ে আসলেও তাদের অনেকের সঙ্গে নিয়ে এসেছে মরণব্যাধি এইচআইভি এইডসসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এইডস রোগী শনাক্ত দিন দিন বাড়ছে। এক সপ্তাহে ১৯ জন এইডস রোগী থেকে বেড়ে ৩৩ জন হয়েছে। এদের মধ্যে ১৮ জন নারী, ১০ জন পুরুষ ও পাঁচজন শিশু। এমনকি চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন এইডস রোগী মরেও গেছে।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে মতে, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বেশির ভাগই পুষ্টিহীনতা, চর্মরোগ, কানপচা, যক্ষ্মা, সর্দি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, হেপাটাইটিস-‘বি’সহ নানা রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে কিছু রোগ নিরাময় করা গেলেও মরণব্যাধি এইচআইভি এইডস রোগীদের নিয়ে বিব্রত চিকিৎসকরা। অনিরাপদ শারীরিক মেলামেশাজনিত কারণে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে সাত হাজার গর্ভবতী নারীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে জন্ম নিয়েছে ৬৬৫ জন শিশু। আটজন ম্যালেরিয়া রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ছয় লাখ ৭৯ হাজার রোহিঙ্গাকে কলেরার ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে। ১৬ হাজার ৮৩৩ জন এতিম শিশুর সন্ধান পাওয়া গেছে।
শারীরিক মেলামেশা জনিত কারণে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় উখিয়া টেকনাফের বৃহত্তর জনসাধারণের মাঝে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
বড় কথা হলো- টেকনাফে রোহিঙ্গার সংখ্যা স্থানীয়দের সংখ্যা এখন প্রায় সমান হয়ে গেছে। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও এত বিপুল রোহিঙ্গার ভার বহন করা প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজনের জন্য সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই বাড়তি মানুষের কারণে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে গাড়ি ভাড়া। স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে সময়মতো যাওয়া-আসা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কাটা হচ্ছে পাহাড়। উজাড় করতে হচ্ছে বন। সরকার দুই হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য শেড নির্মাণ করার ঘোষণা দিলেও আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে তোলার হিড়িক পড়েছে উখিয়া-টেকনাফ রেঞ্জের ১০ হাজার একর ভূমিতে।
একের পর এক বনভূমি দখল করে বন উজাড় হওয়ার কারণে পশু-পাখির আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বনাঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়িত লোকালয়ে হানা দিচ্ছে হাতির পাল।
সম্প্রতি উখিয়ার বালুখালীতে হাতিরপাল হানা দিলে এক রোহিঙ্গা শিশু নিহত হয়। আহত হয় আরো দুজন। গত তিন সপ্তাহে পৃথক ঘটনায় হাতির আক্রমণে পিতা-পুত্রসহ তিন রোহিঙ্গাসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। প্রতিদিনই নতুন নতুন পাহাড়ি জমি দখল করে ইচ্ছেমতো বস্তি তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে হাতি ও পশুপাখির অভয়ারণ্যও হুমকির মুখে পড়েছে।
সবচেয়ে বড় ভয়টি হলো পাহাড় ধসের। এ দেশে এমনিতেই পাহাড় ধসে মানুষ মরে। এর তীব্রতা অনেক বেড়ে যাবে। তাহলে রোহিঙ্গারা যেভাবে অপরাধ কাজে জাড়িয়ে পড়ছে, তাদের রোগ-বালাইগুলো যেভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, বন-জঙ্গল ও পাহাড় কেটে উজার করছে তাতে এটা কি বলতেই হয়- রোহিঙ্গারা সংকট থেকে এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন

মর্তুজা নুর