২২ শে শ্রাবণ
পুনরুজ্জীবনের আরেক দিন
রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন বেঁচেছেন—আপনি আচারি আমাদের দেখিয়েছেন প্রতিদিন নূতন করে বাঁচা কাকে বলে—এই কাজটাই যখন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ভালো করে পারেন, তিনি প্রতিদিন তো বাঁচেনই, বেঁচে ওঠেন তাঁর মৃত্যুর পরপরই। তাঁর শরীরটা কেবল প্রাণহীন হয়, তাঁর চৈতন্য নতুনভাবে ও দীপ্তিতে এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
২২ শ্রাবণ তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু সেটা তো তাঁর সত্তার আরেকটি জন্মদিন মাত্র। তাঁর বহু গানে বারবার ফিরে আসে ভোরের কথা, নতুন ভোরে নতুন প্রাণ পাওয়ার কথা। গীতবিতানের ভূমিকা হিসেবে তিনি যে কবিতা বা গানটি দিয়েছেন, সেখানে এসেছে উষার কথা—প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে/প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে/ প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে/ শুধায় ফিরিল সুর খুঁজে পাবে পাবে॥/ এসো এসো সেই নবসৃষ্টির কবি/ নবজাগরণযুগপ্রভাবতের রবি। তিনি এসব কথা কার জন্য লিখেছেন? সবার জন্য নিশ্চয়ই, কিন্তু সবার আগে এই কথা তো তাঁর নিজের জন্যই সবচেয়ে বড় সত্য ও বাস্তবতা। যেমন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে লেখা তাঁর কবিতা (ডাক্তার বিধানচন্দ্রের অনুরোধে লিখেছিলেন)—এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। কথাগুলো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকেও বলা যায়। তিনি নিজে তাঁর মৃত্যুর বহু আগেই মৃত্যুহীন প্রাণ কী বোধ করতেন। প্রাণ এবং সত্তার দার্শনিক ও বস্তুগত স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর ভেতরে এত এত ইশারা ছিল বলেই তো তাঁর এত সৃষ্টি।
জগতে যা কিছু আছে, তা তো প্রত্যেক মানুষের নিজের ভেতরে আছে, একইভাবে মানুষের ভেতরে যা কিছু আছে, তাই তো জগতে ছড়িয়ে আছে। ব্যক্তি ও বিশ্বের এই সত্য তিনি জানতেন বলে তিনি তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য বিনিময়ের কাজটি করে গেছেন। বিশ্ব তাঁর ভেতর দিয়ে ভাষা পেয়েছে, তিনি বিশ্বের ভেতর দিয়ে ভাষা পেয়েছেন। এ জন্যই তিনি বিশ্বকবি। বৈশ্বিকবোধের ভাষ্যকার। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো, তিনি একটি রাজনৈতিক কবিতাও লেখেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার পর অনেকে তাঁকে এ নিয়ে কবিতা লিখতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তো নাইট উপাধিটাই পরিত্যাগ করেছেন, কবিতা দিয়ে আর কতটুকু প্রতিবাদ হবে? বোধকরি রাজনীতিকে তিনি চিরন্তন বলে মনে করতে পারেননি। মানুষের জন্য চিরকল্যাণের বিষয় বলে বোধ করেননি।
আবু সয়ীদ আইয়ুব একটি লেখায় রাজনীতিকে ‘চিত্তবন্ধনের দ্বিতীয় পালা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘মধ্যযুগে ধর্ম আত্মসাৎ করেছিল শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বিকাশকে। রেনেসাঁসের মূল কথা ছিল চার্চের আওতা থেকে চিত্তের মুক্তি এবং ধর্মসংস্কারের বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন খাতে চিৎপ্রকর্ষের উচ্ছল প্রবাহ।’ কিন্তু বর্তমানে ধর্মের জায়গাটি রাজনীতি দখল করেছে। ‘সে-কালের চার্চের জায়গা জুড়েছে রাজনীতি, অথবা রাজনীতিই এ-কালের চার্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ ফলে এ-কালে আত্মবিকাশের প্রধানতম বাধা হয়ে উঠেছে রাজনীতি। রবীন্দ্রনাথ নিজে ওই ‘চিৎপ্রকর্ষের উচ্ছল প্রবাহটি’কে নানান খাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর বেশিদিন রাজনীতিতে থাকা হয়নি। কিন্তু তাঁর প্রখর রাজনীতিবোধ তিনি কখনো হারাননি। সেটা কালান্তর-এর মতো লেখায় স্পষ্ট, তেমন স্পষ্ট গীতবিতানের ‘স্বদেশ’-এ। ‘জনগণমন-অধিনায়ক’-এর মতো গান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে-রাজনীতি সার্বিক ঐক্যের ডাক দেয় না, তাকে সন্দেহ করা উচিত। যে-রাজনীতি নিত্য বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়—তাকে প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক। বা ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’র মতো গণতান্ত্রিক চেতনার মনে হয় না জগতে খুব একটা পাওয়া যাবে। অথচ তার বদলে নিত্য নিজেদের খাটো করে রাখছি আমরা নানান অসত্যে।
ব্যক্তির বিকাশই বিশ্বের বিকাশ, বিশ্বের বিকাশ মানে ব্যক্তির বিকাশ। ‘স্বদেশ’ শিরোনামে চিহ্নিত গীতবিতানের গানগুলোতেও তাকালে এই কথাটিও মনে না হয়ে পারে না। সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান বা বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি ইত্যাদি গান ব্যক্তিকে আত্মপ্রত্যয়ের স্তরে নিয়ে যেতে পারে। সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ এক চিরন্তন প্রেরণার নাম।
২২ শ্রাবণে তাঁকে স্মরণ করার অন্যতম দিক হলো আমাদের প্রত্যেকের চৈতন্যের প্রতিদিনের জাগরণের বিষয়টিকে খতিয়ে দেখা। এই জাগরণের প্রশ্নটিই বহু লোকের ভেতরে গুটিয়কয়েক ‘জিনিয়াস’-এর জন্ম দেয়। ‘জিনিয়াস’ কথাটিকে বাংলায় প্রতিভা, সৃজনীশীল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা উদ্ভাবনী-বুদ্ধির অধিকারী ইত্যাদি কোনো শব্দ দিয়ে বোঝানো কঠিন। এর সত্যিকারের অর্থ আমরা খুব কম লোকেই জানি। কাকে ‘জিনিয়াস’ বলে, এটা জানি না বলেই হয়তো আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে ‘জিনিয়াস’দের এত অভাব। ল্যু স্যুন তাঁর প্রতিভাবানের প্রতীক্ষায় দেখিয়েছিলেন, একটি জাতি যদি সার্বিকভাবে বিকশিত হয়, তাহলেই সেখানে প্রতিভার উদ্ভব হতে পারে। চীনে এত লোক, কিন্তু প্রতিভাবান এত কম কেন? ল্যু স্যুনের সূত্রে বলা যায়—এটা লোক সংখ্যার বিষয় না যে, যে দেশে যত লোক, সে দেশে তত বেশি প্রতিভার জন্ম হবে।
জনসংখ্যার সঙ্গে বিষয়টি জড়িত নয়। বিষয়টি জনগণের সামগ্রিক প্রগতি ও উন্নয়নের সঙ্গে লগ্ন। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, উনিশ শতক থেকে বাংলায় যে নতুন চেতনা ও প্রগতির প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তারই শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। বহুপ্রতিভার ভেতর থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জিনিয়াস।
জিনিয়াস কে? যে ব্যক্তি ন্যূনতম বা কমপক্ষে তিনটি একেবারে ভিন্নধর্মী বিষয়ের অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করে এর রীতি-পদ্ধতি-প্রয়োগবিধি জানেন এবং তিনি নিজে সেই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত দক্ষতা অর্জন করে একজন ‘ওস্তাদে’ পরিণত হন, তাকেই বলে জিনিয়াস। যেমন বলা যায় কেউ যদি একই সঙ্গে নৌবিদ্যা, শিল্পকলা (আঁকা-লেখা-গাওয়া প্রভৃতি) ও চিকিৎসাবিদ্যায় ওই ওস্তাদ হয়ে ওঠেন, তাহলে তাকে আমরা জিনিয়াস বলতে পারি। জগতের এমন ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। কেউ কেউ তো বলেন, এক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছাড়া সেই অর্থে জিনিয়াস আর কাউকে বলা যায় না। তার পরও হোমার, ভিঞ্চি, শেক্সপিয়র, মোসার্ট, গ্যেটে ও তলস্তয়, নিউটন, ডারউইন, ফ্রয়েড, কুরি এবং আইনস্টাইন—শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের এই বিখ্যাত ব্যক্তিদের ‘জিনিয়াস’ বলা হয়। অ্যান্ড্রু রবিনসন অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন’ সিরিজের ‘জিনিয়াস’ বইটিতে এঁদের সঙ্গে রেখেছেন মাত্র দুজন বাঙালির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়। এবং রোমান বা লাতিন শব্দ থেকে আসা জিনিয়াসের অর্থ তার মতে, সময়ের ক্ষয় এড়িয়ে সেই সব ব্যক্তির সৃষ্টি ও সত্তা, যা মানুষকে নিত্যই প্রতিটি কাজে দিকনির্দেশনা দেয়, তাঁরাই হলেন ‘জিনিয়াস’। এর নিশ্চয়ই বিচিত্র তালিকা করা যায়। পেলে-ম্যারাডোনা ফুটবলে জিনিয়াস, তেমনি পিকাসো-দালি চিত্রকলায় জিনিয়াস।
আমাদের প্রশ্ন হলো, ‘জিনিয়াস’ নামের সেই ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জল’ যিনি প্রতিনিয়ত রুচিশীল শিক্ষিত বাঙালির প্রতিটি কাজে তার অজান্তেই ওই ভূমিকা রাখছেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সেখানে আর কার কথা সবার আগে ভাবা যেতে পারে? তাই রবীন্দ্রনাথের জন্ম বা মৃত্যুর দিন উদযাপন একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তিনি জন্ম ও মৃত্যুর সব রকমের সীমাবদ্ধতা পার হয়ে সেই সত্তা হয়ে কাজ করে চলেছেন—প্রতিটি মুহূর্তে সত্যিকারের কাজের কাজে—যাকে আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে।
ভারতের অন্যতম আধ্যাত্মিক শিক্ষক ভগবান রজনীশ বা ওশো সম্পর্কে বলা হয়, তিনি জন্মাননি এবং মৃত্যুবরণও করেননি। তিনি কেবল ১১ ডিসেম্বর ১৯৩১ থেকে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে ভ্রমণ করেছেন মাত্র। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও ভক্তির জায়গা থেকে অনেকে এটাই ভাবতে পারেন। কিন্তু তাকে ভক্তির জায়গা থেকে দেখাটা ঠিক নয়। হুমায়ুন আজাদের কথা ছিল—রবীন্দ্রনাথকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে করে বুঝে নিতে হবে। আবদুশ শাকুর ‘রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল’ (যে বইটি কলকাতা থেকে ‘রবীন্দ্রনাথ মানুষ ছিলেন’ নামেও প্রকাশিত হয়েছে) বইতে ‘কবিগুরু’ ভাবমূর্তিটাকে অনেকটাই ভেঙে দেওয়ার মতো নানান তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন। তার মানে এই নয়, ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথের চরিত্র ও কাজের নানান ক্ষুদ্রতার পরিচয় পাওয়ার পর তাঁর সৃষ্টিকে আমরা পরিত্যাগ করব। বরং তাঁর ঋষিপ্রতিম ছবিটা চুরমার করে দিতে পারলেই মনে হয়, তিনি আমাদের আরো বেশি আপন হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে আমরা ততটাই নিবিড় করে জানতে আগ্রহী হব।
আমাদের তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের দিকে আমাদের যাত্রার শুরুটাই করতে হবে তাঁর সম্পর্কে ভক্তি গদ গদ মানসিকতাকে দূর করে। রবীন্দ্রমোহ বা রবীন্দ্রমুগ্ধতা আদতে তাঁর সৃষ্টিকে জানা ও তাকে জানা- বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথকে বোঝার ও জানার ক্ষেত্রটা সুনির্দিষ্ট নয়। এক অর্থে সীমাহীন, অন্য অর্থে প্রায় অসম্ভব। কারণ মানবজীবনের এত দিকে তিনি পা ফেলেছেন যে ‘সর্বত্রগামী’র চেয়ে ‘বিচিত্রগামী’ হয়ে ওঠাটা তাকে আসলে আরো বেশি সর্বত্রগামী করে তুলেছে। তবে তাকে সক্রেটিস-মার্কস-ফ্রয়েড থেকে শুরু করে সার্ত্র-কাম্যু-লাঁকা-ফুকো-দেরিদা দিয়ে ঝালাই করতে গেলে মনে হয় একটু সমস্যা হবে। এমনকি আধুনিক, আধুনিকতা ও আধুনিকবাদ দিয়ে তাঁকে যাচাই করতে গেলেও ঝামেলা হবে। তাঁর সব কথা এই আধুনিকতার তালে মিলতে নাও পারে। কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথ তেমন বিচলিত নন, তিনি বলেছিলেন, ‘আধুনিক-কাল-বিলাসীরা অবজ্ঞার সঙ্গে বলতে পারেন এ-সব কথা আধুনিক বুলির সঙ্গে মিলছে না, তা যদি হয় তা হলে সেই আধুনিক কালটার জন্য পরিতাপ করতে হবে। আশ্বাসের কথা এই যে, সে চিরকালই আধুনিক থাকবে এত আয়ু তার নয়।’ ফলে আধুনিকতা নিয়ে যারা চোটপাট করেন তাদের এই কথাটা জেনে রাখাটা ভালো। কারণ রবীন্দ্রনাথ বোধ করি দুটো বিষয়—চিরন্তন ও নূতন—এই মেনে চলেছেন এবং তার ভেতর দিয়ে ‘আনন্দ’কে পেতে চেয়েছেন, এই ‘আনন্দ’ ফুর্তির আনন্দ নয়; জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছুকে আস্বাদের আনন্দ। মহামানবের মহাউদ্দেশ্যে মহাতীর্থে তাঁর যাত্রা তিনি একদিনের জন্য থামেনি। সত্তার প্রথম আবির্ভাব থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ভেতরে যে প্রশ্ন তিনি লালন করেছেন, বিচিত্র ছলনার জাল ছিঁড়ে নিজেকে নিজের সৃষ্টির পথে অটুট রাখতে পেরেছেন তা-ই তাঁর হয়ে ওঠার কারণ ছিল। তাঁর এই হয়ে ওঠার পথটিকে চিনের নিতে পারলে আলাদা করে আর তাঁকে দিনক্ষণ ধরে স্মরণ করা লাগে না। জন্ম-মৃত্যু পার হয়ে তিনি নিত্যদিনের হয়ে ওঠেন। এমনকি তাঁকে পার হয়ে যাওয়ার পথটাও তিনি, রবীন্দ্রনাথ, নিজেই দেখিয়ে দেন। সেই পথটা চীনের নেওয়ার জন্য তাঁকে সঙ্গী করেই আমাদের যাত্রা অব্যাহত রাখা চাই। তাতেই কাজগুলো কাজ হবে। অনুষ্ঠানিকতার হাত থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে।
লেখক : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি