বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী আজ

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/শত কৌতূহল ভরে অথবা, আজি হতে শতবর্ষ পরে... ’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশ বছরের বেশি আগে বাঙালি পাঠককে এ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সেই চিরজাগরূক, বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের অন্যতম শীর্ষ রূপকার, কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী আজ শুক্রবার।
দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বাণী দিয়েছেন। এ ছাড়া নানা আয়োজনে দেশব্যাপী দিবসটি উদযাপিত হবে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রবীন্দ্র-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, রবীন্দ্র-চেতনার আলোকে ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।’
ক্ষণজন্মা এই কবির অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্যই আনন্দের বার্তাবহ। কারণ, বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বাঙালি জাতিকে তিনি দিয়েছেন শুভ-সুন্দর ও কল্যাণের শাশ্বত বার্তা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ মানেই মহৎ মানবিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, যা ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের সংকীর্ণ সীমা ভেদ করে রূপসাগরে গান গায় অরূপরতনের। কবির এই অরূপরতন তো প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবন দর্শনেরই নাম, যে দর্শনের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার শিল্পিত রূপায়ণ।
রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় তো বটেই, বাঙালি সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রকে প্রায় একক চেষ্টায় তিনি দান করেছেন নতুনতর মাত্রা। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বিশ্বসাহিত্যের বৃহৎ পরিসরে বাংলা সাহিত্যের অভিষেক ঘটানোর পাশাপাশি তাঁর কৃষি ব্যাংকিং-সমবায়-শিক্ষা সংগঠন এক জীবনে তাঁকে দিয়েছে বিশাল ব্যাপ্তি। রবীন্দ্রনাথ মানুষের আত্মশক্তির উদ্বোধন চেয়েছেন উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, চাপিয়ে দেওয়া দর্শন, সাম্রাজ্যবাদ ও অশুভের বদলে মানুষের সুকুমার সত্তার বিকাশ সাধনই ছিল রবীন্দ্র-দর্শনের মর্মকথা।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষার বৈচিত্র্যে সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তিনি আশা করেন, আমাদের মননে বিশ্বকবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও অমানবিকতা প্রতিরোধে বাঙালির অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখবে।
‘কবিগুরুর জন্মবার্ষিকীর সূচনালগ্নে শান্তিময় পৃথিবী গড়াই হোক আমাদের প্রত্যয়’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও বাঙালির শৈল্পিক অহংকারের এক বিশ্বব্যাপ্ত নাম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে দেখেছেন অত্যন্ত গভীরভাবে, যা তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকাহিনী, সংগীত ও চিত্রকলায় সহস্রধারায় উৎসরিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কালোত্তীর্ণ এ কবির সৃষ্টিকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জাতির পিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেন, যা দেশের মানুষের মনে সঞ্চারিত করেছে দেশপ্রেমের নতুন প্রেরণা।
বিরোধীদলীয় নেতার বাণী
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতায় উজ্জ্বল করে বিশ্বসাহিত্য আসরে সুপ্রতিষ্ঠিত করে বাংলা ও বাঙালিকে অনন্য এক মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন।
রওশন এরশাদ আরো বলেন, কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়ার জন্য, স্বপ্নময় শান্তিপূর্ণ নতুন পৃথিবী গড়তে রবীন্দ্র-চেতনা কেবল বাঙালি জাতিকে নয়, পৃথিবীর অন্য দেশের অন্য গোলার্ধের মানুষকেও অনুপ্রাণিত করবে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের বাণী
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনী দ্বারা আজও আমরা সবাই উদ্বুদ্ধ হই এবং একই সঙ্গে তা সমাজের অনাচার, অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘তাঁর সাহিত্যকর্মে শান্তি, মানবতা, মহত্ত্ববোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার বাণী যুগে যুগে মানুষকে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁর সৃষ্টিকর্ম জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে দেশ-দেশান্তরে হয়ে উঠেছে কল্যাণের অকৃত্রিম আলেখ্য। মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম ও দেশপ্রেম তাঁর লেখনীর প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে।’
খালেদা জিয়া বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অম্লান স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন।
দিবসের কর্মসূচি
দিনটি উপলক্ষে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’।
জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। ঢাকাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
শুধু দুই বাংলার বাঙালিই নয়, পুরো ভারতবাসী, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষাভাষী, অন্য ভাষার ভক্তরা কবির জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়।
কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজাদপুরের পাইলট হাই স্কুল মাঠে সকাল ১০টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. হাসিবুর রহমান স্বপন উপস্থিত থাকবেন।
স্বাগত বক্তৃতা দেবেন ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। রবীন্দ্রস্মারক বক্তা হিসেবে ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উপস্থিত থাকবেন। আজ বিকেলে এবং পরবর্তী তিন দিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকাসহ কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর ও খুলনার দক্ষিণডিহিতে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন করবে।
জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এ অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস জোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাগুলো প্রাণের সঞ্চার করে।
কবির লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কবির বিভিন্ন রচনা স্বাধীনতা অর্জনে বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছিল। এ জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, কথাসাহিত্য, কৃষি, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের জাগরণে কবি রবীন্দ্রনাথ পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।