গণপরিবহন
অ্যাপভিত্তিক রাইড বনাম অলীক আন্দোলন
রোজকার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনেই মানুষকে একস্থান থেকে অন্যত্র গমনাগমন করতে হয়। লাখো মানুষের এই যাতায়াতের বড় মাধ্যম হলো গণপরিবহন। বাংলাদেশের সামগ্রিক গণপরিবহনের অবস্থা এমন যে, এখানকার সেবাদাতা সংস্থারা যাত্রীসেবার দিকে ন্যূনতম দৃষ্টিপাত না করে নিজেদের স্বার্থে যাচ্ছেতাই করে পার পেয়ে যায়। দেশে সড়ক পরিবহন আইন, ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন, মোটরযান এক্সেল লোড কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ আইন, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড আইন নামে বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা ও আইন জারি আছে। তারপরও বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরে উল্লেখ করবার মতো সামান্যতম শৃঙ্খলাটুকু আছে-এমনটা দেখা যায় না। এমন বিশৃঙ্খলার সর্বশেষ সংযোজন অ্যাপভিত্তিক রাইড বনাম সিএনজি অটোরিকশার অবাস্তব আন্দোলন।
মাত্র বছরখানেকের মাথায় দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা। বাজারে আসা নতুন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পুরোনো পরিবহন সেবাসংস্থাগুলোও এখন প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে নিজেদের স্মার্টফোনের অ্যাপভিত্তিক সেবায় বিস্তৃত করছে। ফলে এ খাতে তৈরি হচ্ছে প্রতিযোগিতার পরিবেশ। যা থেকে দিনদিন ভোক্তাশ্রেণি বা যাত্রীসাধারণের কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি মোটরসাইকেল সেবা দেওয়ায় খ্যাত প্রতিষ্ঠান পাঠাও নিয়ে এসেছে গাড়িসেবা, তেমনি গাড়িসেবা দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া উবার নিয়ে এসেছে মোটরসাইকেল সুবিধা। যাত্রীরাও তাদের স্মার্টফোন থেকে দরদাম করে খুব সহজেই উবারের ট্যাক্সিক্যাব বা পাঠাও’র মোটরবাইক সেবা নিতে পারছেন। এমন একটা সময়ে সিএনজি অটোরিকশা চালক ও মালিকরা তাদের ব্যবসায় মার খাচ্ছে বলে উবার ও পাঠাওএর সেবা বন্ধের দাবি জানাচ্ছে। তাদের এ এক অদ্ভুত চাওয়া! সিএনজিচালিত অটোরিকশাওয়ালাদের চরম স্বেচ্ছাচারিতা, অনিরাপত্তা এবং একচেটিয়া ব্যবসার বিপরীতে সাধারণ মানুষ যখন পাঠাও-উবারে স্বস্তি খুঁজছে সেই সময় তাদের এমন দাবি স্রেফ বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ ‘মামা বাড়ির আবদার’- কেই মনে করিয়ে দেয়।
নিজেদের সেবার মান বৃদ্ধি কিংবা যাত্রীসেবায় যুগোপযোগিতা চিন্তা না করে হাস্যকরভাবে অন্যদের সেবা বাতিলের দাবি তোলা হচ্ছে। আমাদের দেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও কি এমনটা কল্পনা করা যাবে যে, নিজের মন্দ পণ্যের বাজার ঠিক রাখতে উন্নত কোনো পণ্যের প্রচার প্রসার বাঁধাগ্রস্ত করা যায়!
যেসময় ২০১৯ সালের মধ্যে ২৪ হাজার চালকবিহীন গাড়ি ক্রয় এবং ২০২৩ সাল নাগাদ ফ্লাইং ট্যাক্সি নামে উড়ন্ত গাড়িসেবা চালু করবার কথা ভাবছে মার্কিন অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান উবার। সেই সময় আমরা দেশ থেকে তাদের ট্যাক্সি সেবা গুটিয়ে নেওয়ার দাবি তুলছি। কী বিস্ময়কর চিন্তাচেতনা আমাদের!
আমরা যাত্রীরা এককথায় এর উত্তর দিতে পারি, কী হবে যদি রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশাই না থাকে? মানুষ হাঁটতে শিখবে, মহামূল্যবান গ্যাস বাঁচবে, মহাসড়কে যখন-তখন দুর্ঘটনা ঘটবে না, যাত্রীর পকেট থেকে অতিরিক্ত পয়সা ব্যয় হবে না। এমনকি ভদ্রবেশি সিএনজিচালক সেজে কোনো ছিনতাইকারী অসহায় যাত্রীর পেটে ছুড়িও চালাতে পারবে না! এমন বাস্তবতায় সিএনজিওয়ালাদের আন্দোলন কেন অংকুরেই বিনাশ করা হচ্ছে না। এরও একটা লাভালাভের রাজনীতি আছে নিশ্চয়।
‘দ্য ডেইলি স্টার’-এ প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ‘স্মার্টফোনের অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা উবার ও পাঠাও বন্ধসহ মোট আট দফা দাবিতে ঢাকায় আগামী ২৭ ও ২৮ নভেম্বর ধর্মঘট পালন করবেন অটোরিকশাচালকরা। গত বেশ কিছুদিন থেকেই উবার ও পাঠাও বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা। ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা ও মিশুক ইউনিয়নের সদস্য সচিব শাখাওয়াত হোসেন দুলাল ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া তারা ওই দাবিতে বিক্ষোভ করবে এবং বিআরটিএ অফিস ঘেরাও করবে বলেও জানিয়েছেন।‘
নিজেদেরকে যাত্রীবান্ধব করে গড়ে তুলবেন এমন দাবি নিশ্চয় তাদের ৮ দফার মধ্যে নেই। তাহলে সিএনজি অটোরিকশাওয়ালাদের কে বুঝাবে যে, নিজেদের অনৈতিক দাবি আদায়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলন করবার অধিকার তাদের থাকা উচিৎ নয়? সিএনজি চালকদের মর্জির ওপর যাত্রীর নির্ভরতা আর কতদিন? তারা নিজেদের না বদলিয়ে যাত্রীর উন্নততর সেবাপ্রাপ্যতা কেন বন্ধ করবেন? মিটারে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা যখন তা ভুলে নিজের ইচ্ছেসই কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করে অসহায় যাত্রীর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখেন, মুমূর্ষু রোগী কিংবা পরীক্ষার্থী কোনো শিক্ষার্থী পেলে অতিরিক্ত অর্থলিপ্সার সর্বোচ্চ অধঃপতন দেখান–এসবের বিরুদ্ধে গা সওয়া যাত্রীরা তো কোনোদিন আন্দোলন করেনি। এখন উবার বা পাঠাও-এ শান্তি খোঁজা সেই ভুক্তভোগী যাত্রীদেরকে বাঁধাগ্রস্ত করার তারা কে?
সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা প্রায়ই বলেন, মালিকের চাহিদা মতো পুরো একদিনের হাজার -১২০০ টাকা ভাড়া গুনতে তারা হিমশিম খায়। অন্যদিকে মালিকরা বলে, বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিএনজি কিনে এবং নানা ঘাটে টাকা ঢালতে গিয়ে তাদের পোষায় না। ফলে এর সব চাপ নিয়ে তারা যাত্রীদের পর্যুদস্তু করতে বাধ্য হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। ডিসিপ্লিন মেইন্টেইন করে চলা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উবার-পাঠাওএর পোষালে সিএনজিওয়ালাদের কেন পোষাচ্ছে না? বাংলাদেশের সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে এমন একজনকেও কি পাওয়া যাবে, যার সাথে জীবনে কোনোদিন অতিরিক্ত ভাড়া কিংবা নির্ধারিত গন্তব্যে যাওয়া নিয়ে সিএনজিওয়ালাদের সাথে বচসা হয়নি? বাস-ট্রাকও ভয়ানক বিশৃঙ্খল। বাস ভাড়ারও আছে নানা তালবাহানা। আছে স্টাফদের অসহ্য দুর্ব্যবহার। কিন্তু সিএনজির বাহানা সবসময় এককাঁঠি সরস।
তাহলে সিএনজি অথবা মুড়ির টিন গণপরিবহনের জুলুমবাজিতে হাবুডুবু খাওয়া যাত্রীরা যদি অ্যাপভিত্তিত রাইডে চড়তে চায়, তাদের কী দোষ দেওয়া যায়? যাত্রীকে জিম্মিদশায় ফেলে একচ্ছত্র ফায়দা লুটবার ফন্দিফিকির করা কি কারো সাজে?
প্রত্যাশিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনুকূল টেকসই, নিরাপদ ও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো এবং সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সড়ক বিভাগ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এমনটাই বলা আছে, সড়ক বিভাগ কিংবা বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের ওয়েবসাইটগুলোতে। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই ভিন্ন এবং মর্মান্তিক।
সম্প্রতি বেসরকারি সেবা সংস্থা একশনএইড ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’- শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ঢাকা শহরে বসবাসকারী ৫৬ শতাংশ নারী ভালো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকার কারণে বাইরে যেতে চায় না। আবার অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ৫৮ শতাংশ নারী গণপরিবহনে উঠতে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা ও নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে বাদ দিয়ে কাঠামো তৈরি করা। রাজধানীর গণপরিবহন সম্পর্কে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা যানজট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। আর ৭৮.৫ শতাংশ নারী বলেছে, বাসের সংখ্যা অপ্রতুল। অন্যদিকে ২২.৫ শতাংশ নারী বাস সহকাররী/চালক/সহযাত্রীর কাছ থেকে যৌন হয়রানিরও শিকার হয়।’
এখন পর্যন্ত সমন্বিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও গড়ে তোলা যায়নি। আমাদের গণপরিবহন নারী বা শিশুবান্ধব নয় মোটেও। এমন একটা অবস্থার মধ্যে কারো দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উবার কিংবা পাঠাওএর মতো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবাসংস্থাগুলো বন্ধ করবার চিন্তাটা হবে মরার ওপর খাড়ার ঘা। আমরা চাই সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিয়ন্ত্রকরা তাদের আন্দোলন থেকে সরে এসে অ্যাপভিত্তিক শৃঙ্খলায় ফিরে আসুক। মাইলেজ অনুযায়ী ন্যায্য ভাড়া নিশ্চিত করুক। যাত্রী নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সেবার কথা ভাবুক। তারপর অন্য রাইড শেয়ারিং সেবাদাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামুক। সুনিশ্চিত থাকুক ভালো গণপরিবহন বেছে নেওয়ার আমাদের যাত্রীসাধারণের নাগরিক অধিকার।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন

ফারদিন ফেরদৌস