পাঠকের কলাম
অটুট থাকুক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাংলাদেশের উৎসবপ্রিয় মানুষ সব সময়ই মিলেমিশে বাস করতে অভ্যস্ত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মেলায়, বিয়েতে, পূজা-পার্বণে, ঈদে, মিলাদে হৈ হৈ রৈ রৈ করে দল বেঁধে যোগ দেওয়ার রেওয়াজ এই মাটিতে বহু পুরোনো। কি হিন্দু, কি মুসলিম, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে একত্রে যোগ দেওয়ার রীতিও এখানে বহুকালের। একসাথে ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, আদান-প্রদান, লেনদেনের রীতি এখানকার সংস্কৃতিকে বেঁধেছে একই মেলবন্ধনে। যে ঢঙে কীর্তন গায় হিন্দুরা, একই ঢঙে গজল গায় মুসলিম সমাজ। কীর্তনের সুরে সুরে যেমন হেসে বেড়ায় ভৈরবী শ্যামাসংগীত, গজলের মধ্যেও এর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। চিরায়ত বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য বাউল গান, সুফি গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি-সারিতে হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে একাকার। এ অঞ্চলের মানুষ যে ধর্মেরই হোক না কেন, আনন্দ-উল্লাসে তালে তাল মিলিয়ে মেতে ওঠে উৎসবে।
এই উৎসবপ্রিয় জনগণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ফুলে বিষ ঢেলে দিতে সচেষ্ট কিছু গণ্ডমূর্খ উগ্র সুবিধাবাদী! এরা রাতের আঁধারে চোরের মতো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা ভাঙে, মন্দিরে ভাঙচুর চালায়। আমার ধারণা এরা কোনো ধর্মের না, কোনো সম্প্রদায়ের না! উগ্রতাই এদের ধর্ম। ভণ্ডামি এদের সম্প্রদায়! এদের মূল টার্গেট সুবিধাভোগ! অর্থবিত্ত ক্ষমতা জায়গা দখল! কিঞ্চিৎ সুবিধা ভোগের জন্য, টু-পাইস কামানোর জন্য এরা মন্দির, মসজিদ কোনোটা ভাঙতেই দ্বিধা করে না! অথচ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ একত্রে মিলেমিশে বসবাস আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য।
আমাদের প্রাইমারি স্কুলে শিপেন স্যার নামের একজন স্যার ছিলেন। স্কুলের সামনেই জামে মসজিদ। ছোটবেলায় দেখেছি, শিপেন স্যার ১১টা সাড়ে ১১টার দিকে মসজিদের কল থেকে অজু করে মসজিদে ঢুকতেন। একটি কোরআন শরিফ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে পড়তেন। তিনি আরবি পড়তে পারতেন। অর্থও বুঝতেন। এলাকার মাথামুরব্বি সবাই ব্যাপারটা জানত। কাউকে কোনোদিন এ কথা বলতে শুনিনি, অ্যাই হিন্দুর ব্যাটা? মসজিদে ঢুকেছিস কেন?
মাঝেমধ্যে কৌতূহলবশত কোরআন পড়তেন বলে যে শিপেন স্যার মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন, তা কিন্তু না। ওনার ভাষ্যমতে, এটা পড়ে নাকি এক ধরনের তৃপ্তি আসত তাঁর মনে! তাঁর ভাষ্যমতে, সবই তো ওই ঈশ্বরেরই কথা। সকালে বের হওয়ার আগে বাসায় পড়তেন গীতা। বাইবেল-ত্রিপিটকও ছিল তাঁর সংগ্রহে।
শিপেন স্যার, অসিত স্যারসহ আরো অনেকেই এলাকার খুব গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন তখন। এখনো অনেকে আছেন। সব অনুষ্ঠান আয়োজনে তাঁদের জন্য চেয়ার নির্দিষ্ট। সম্মানের জায়গায় কারো চেয়ে কম পান না তাঁরা।
আমার আব্বা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেছেন কখনো দেখিনি। তাঁর হাটে-বাজারে নানা কাজকর্মের জন্য বিভিন্ন লোকের সাথে ওঠাবসায় হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ করতে কখনো দেখিনি। উল্টো ভিন্ন ধর্মের লোকদের সাথে সদ্ভাবই দেখেছি। আমাদের পাশের এলাকায় বেশ কিছু হিন্দু জেলে আছে। ওরা আব্বাকে দেখলেই ভালো মাছটা ধরিয়ে দেয়। বেশ কিছু লোক দুধ বিক্রি করে, দুধ নেওয়ার জন্য তাদের আব্বার বেশি পছন্দ। কোনোদিন আব্বাকে বলতে শুনিনি, এরা হিন্দুর জাত! এদের সাথে লেনদেন করা খারাপ! গ্রামের অন্যদের মধ্যেও এমন মনোভাব দেখিনি। কোনোদিন এলাকায় শুনিনি একটা মন্দিরে আঁচড় পড়েছে। একটা প্রতিমা ভেঙেছে কেউ!
ছোটবেলায় পূজা দেখতে যেতাম। একবার গেলাম আমরা দুই ভাই। আমি ছয়-সাত বছরের। বড় ভাই ১০-১২। তো, বায়না ধরলাম পূজা দেখতে যাব। মা যেতে দিতে চাইলেন না। আব্বা বললেন, যাক! গিয়ে দেখে আসুক। সব দেখার প্রয়োজন আছে! ওরা তো আর পূজা করবে না। গিয়ে দেখে চলে আসবে।
আমরা দুই ভাই গেলাম। বিসর্জনের দিন। লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে বাতাসা ছিটানো হচ্ছে। আমি জনগণের প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একটাও ধরতে পারছি না। বড় ভাই আমাকে উঁচুমতো একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি বাতাসা ধইরা আনি। সে বাতাসা ধরতে গেল। মিনিট দশেক হয়ে গেল এখনো আসছে না। এদিকে আমার ভয় এত লোকের ভিড়ে না জানি সে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কান্না চেপে গেল। ফোস ফোস করে কাঁদতে লাগলাম। আমার বড় ভাই আমাকে রেখে হারিয়ে গেছে।
পূজামণ্ডপের সামনে আমাকে কাঁদতে দেখে এক মামা চিনে ফেললেন। সাথে করে এনে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। মণ্ডপ আমাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরের বাজারে। আমি তখনো একা একা বাজারে যাওয়া শিখিনি।
ওদিকে কিছুক্ষণ পর এক কোছা বাতাসা নিয়ে এসে বড় ভাই আমাকে না পেয়ে সেও গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। সে কাঁদছে তার ছোট ভাই হারিয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আমাকে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলো। আসার আগে রাগে-দুঃখে বাতাসাগুলো মূর্তির সাথে নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিল। বাড়িতে এসে দেখে আমি খেতে বসেছি। আমাকে দেখে সে তো ক্ষেপে বোম! যেকোনো মুহূর্তে দুম করে ফেটে যাবে অবস্থা। আমিও মায়ের কাছছাড়া হলাম না। জানি একা পেলেই পিঠ বাঁকিয়ে ফেলবে!
ছোটবেলায় গিয়েছি, এখনো যাই। সুযোগ পেলেই পূজামণ্ডপ একবার ঘুরে আসি। আমার ভালো লাগে। ঢাকের শব্দ, ধূপের ধোঁয়া, আরতি সব দেখে অন্য রকম ভালো লাগে। কত কত লোক! সবার চেহারার মধ্যে একটা পবিত্র পবিত্র ভাব। এর মানে আমি পূজা করতে যাইনি! মণ্ডপে প্রতিমা দেখতে গেছি বলে হিন্দু হয়ে যাইনি!
ঈদের দিনও আমার এ রকম পবিত্র পবিত্র ভাব লাগে। ছোটবেলায় ঈদের মাঠে গিয়ে নামাজ পড়তাম না। লোকজন যখন নামাজে দাঁড়াত, আমি দেখতাম। একসাথে কত লোক দাঁড়িয়ে আছে, রুকু-সিজদা করছে, সব থেকে ভালো লাগার সময় হলো মাঠভর্তি লোকজন যখন একসাথে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদায় গেছে। আমার মনে হতো, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর হয় না।
কোনো ধর্মই মানুষকে খারাপ হতে শেখায় না। প্রতিটি ধর্মই মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে থাকতে শেখায়। অপরের চুল পরিমাণ ক্ষতি না করতে শেখায়। কোনো মুসলিম যদি দাবি করে সে মুসলিম অথচ সে মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, মানুষের ক্ষতি করে, হাদিস মতে সে প্রকৃত মুসলিম না। এখন যারা মন্দির ভাঙে, অন্যধর্মের লোকজনের মালামাল লুণ্ঠন করে তারা মুসলিম কি না তারাই ভেবে দেখুক!
উগ্র শ্রেণির লোকজনের সেন্টিমেন্ট সব সময় আসলে একই। সে যে ধর্মেরই হোক না কেন! একদল মন্দির ভাঙে, আরেক দল কোরবানির বিরোধিতা করে। পশু কোরবানি দেখে তাদের মায়াময় অন্তরটা কেঁদে ওঠে। ভাবখানা এমন যে উনি জীবনে কোনো পশুর মাংস খান না। আজীবন ঘাস খেয়ে বাঁচেন। মানুষের পর মানুষ মেরে শেষ করে দিচ্ছে তাতে তাদের যতটা না লাগে, তার চেয়ে বেশি লাগে কোরবানির সময় পশু জবাই করা দেখলে! অথচ মাংস ছাড়া এদের মুখে খাবার রুচে না!
আরেক শ্রেণি আছে যাদের সব কিছুতেই সমস্যা। এরা কোনো ধর্মকর্ম মানে না। তা ভাই নাই মানতে পারেন। সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি আস্তিক কি নাস্তিক সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই! তবে শেষ বিকেলে যখন হজ সেরে আসেন, মায়ের কবরের পাশে নিজের কবরখানা করে দেওয়ার অনুরোধ করে যান- আপনাদের মতো কেউ কেউ, তখন একটু হাসি পেলে দোষ দিতে পারবেন কি? তারপরও সবই আপনার একান্ত ইচ্ছা। যা খুশি করুন! কিন্তু দুই আনার মস্তিষ্ক নিয়ে বিশ্বের স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সমালোচনা করেন কোন মুখে? বিশ্বব্যাপী ওনারা স্বীকৃত হয়েছেন এমনি এমনি? যুক্তির বিচারে তাঁরা অন্তত আমার-আপনার চেয়ে এগিয়ে আছেন সে কথা সর্বজনবিদিত।
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাদও দেন, তারপরও তাঁরা যাপিত জীবন অনুসারেও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ। আপনি কী এমন করেছেন যে আপনার কথা মানুষ শুনবে? ওনারা যে পথ দেখিয়ে গেছেন, সেই সবের থেকে ভালো পথ আছে আগে সেটা খুঁজে বের করেন। পারলে তারপর ওনাদের নিয়ে সমালোচনা করবেন! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মূলে এই শ্রেণির লোকদের ভূমিকা অনেকাংশে অন্যদের চেয়েও বেশি!
ধর্ম যার যার, দেশটা সবার! এই দেশে আছে সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের মিলেমিশে বসবাস করার সুদীর্ঘ অতীত। চাষা, চামার, কুলি কামার, তাঁতি, জেলে, মুচি, ডোম, চণ্ডাল, হরিজন সব মিলেমিশে একাকার এই বাংলায়। আমরা সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অধিবাসী। তুচ্ছু তুচ্ছ কিছু ঘটনা, গুটি কয় মানুষের প্ররোচনা আমাদের শত বছরের লালিত সেই সম্প্রীতির দেয়ালে ফাটল ধরাতে পারে না।
সময় হয়েছে এখন নতুন প্রজন্মের সজাগ হওয়ার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্ম দায়িত্ব নিক কাঁধে যে আর একজনও ভিন্নধর্মী লাঞ্ছিত হবে না, আর একটা মন্দির ভাঙবে না, একটা প্রতিমা ভাঙবে না। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম বলেই তাঁকে জঙ্গি বা উগ্র ভাববে না। এ দায়িত্ব একা পালন কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একসাথে নামতে হবে মাঠে।
আমরা আশা নিয়ে বাঁচি, স্বপ্ন নিয়ে চলি পথ। স্বপ্ন দেখি একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের! স্বপ্ন দেখি একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। জয় হোক বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির!
সবাইকে শারদীয় দুর্গাপূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।