সাদা চোখে
ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি!
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/02/28/photo-1456643989.jpg)
গত বছর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হওয়া চীনের অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব এ বছর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের প্রথম কর্মদিবস থেকে বিশ্বের প্রধান পুঁজিবাজারগুলোতে অস্বাভাবিক দরপতন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ৩০ ডলারের নিচে নেমে আসা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ঋণসংকট, মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত, ইমার্জিং মার্কেটের সংকট—সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের মতো বৃহৎ ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের ভালো মানের বন্ড রেখে বাকি সব বিনিয়োগ উঠিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
মেগা ব্যাংক গোল্ডম্যান সেকসের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি সংকটের তৃতীয় তরঙ্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। চিন্তিত হওয়ার মতো সতর্কবাণীটি আসে দ্য ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের (বিআইএস) কাছ থেকে। ব্যাংকটির ভাষ্যমতে, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের হাতে তেমন কোনো পথ খোলা নেই।
বিআইএসের বিবৃতিটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ইউরোপ, আমেরিকা ও চীন তাদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় যেসব কৌশল অবলম্বন করেছিল, তা দৃশ্যত সমস্যাকে আরো প্রকট করেছে।
প্রথমেই চীনের চলমান সংকট পর্যালোচনা করা যাক। ২০০৮-পূর্ববর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি নিয়ে চীনকে তেমন ভাবতে হয়নি। কিন্তু ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ভরতা কমাতে চীন সে সময় তার অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কার করে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ ও ভোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। স্বাভাবিকভাবে অভ্যন্তরীণ বাজারে ঋণের চাহিদা ও জোগান বেড়ে যায়। কিন্তু ঋণের জোগান এতটাই বেশি ছিল যে শেষ আট বছরে ব্যবসায়িক ঋণের পরিমাণ ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে পুঁজি স্থানান্তরের সুবিধা না থাকায় চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আবাসন শিল্প ও পুঁজিবাজারে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করতে থকে। ঋণের অর্থে ফুলে-ফেঁপে ওঠে আবাসন শিল্প ও পুঁজিবাজার।
ঋণের অর্থে সৃষ্ট উন্নয়নের বেলুন একসময় বিস্ফোরিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ঘটল। পুঁজিবাজারগুলোতে একে একে ধস শুরু হলো। ধস শুরুর প্রথম ১৭ দিনেই সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যায়। সরকার বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েও পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এ বছরের শুরুতে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জে অস্থিরতা শুরু হলে বিশ্বের প্রধান প্রধান পুঁজিবাজারে শুরু হয় ব্যাপক দরপতন। আবাসন শিল্প, পুঁজিবাজার ও করপোরেশনগুলো একে একে সংকটে পড়তে শুরু করে। স্থবির হতে থাকে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি।
একদিকে রপ্তানি হ্রাস, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। স্বাভাবিকভাবেই চীন জ্বালানি তেল ও কাঁচামাল আমদানি কমিয়ে দেয়। এতে প্রভাবিত হয় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অর্থনীতি। অন্যদিকে ভূরাজনীতির জটিল সমীকরণ মেলাতে সৌদি আরব জ্বালানি তেলের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। চাহিদার অতিরিক্ত সরবরাহ হওয়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার থেকে ৩০ ডলারে নেমে আসে। এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতি। বিশেষ করে রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।
জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় বেড়ে যায় ডলারের দাম। এতে প্রভাবিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি। ২০০৭-০৮ সালে সংকট শুরু হলে বুশ প্রশাসন বেলআউট প্রোগ্রাম, কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং-এর মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করে বড় ব্যাংকগুলোকে সাময়িকভাবে বিপদমুক্ত করলেও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। ওবামা প্রশাসন বেকারত্ব হ্রাসে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও রিয়েল জিডিপিতে আশানুরূপ পরিবর্তন আনতে পারেনি।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খুচরা ও পাইকারি বিক্রি, কারখানা উৎপাদন, করপোরেট মুনাফা সবকিছুই নিম্নগামী। নমিনাল জিডিপি বেড়েছে দাবি করলেও রিয়েল জিডিপিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শিক্ষাঋণ সংকট। ফেডারেল রিজার্ভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঋণের পরিমাণ আনুমানিক ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। চার কোটি ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৭০ লাখ ঋণগ্রহীতা অর্থ পরিশোধে অক্ষম। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র সাব-প্রাইম মর্টগেজের মতো আরেকটা সংকটের দ্বারপ্রান্তে।
অন্যদিকে, ইউরোপেও ঋণসংকট দিন দিন বেড়েই চলছে। সংকট নিরসনে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক বিভিন্ন পর্যায়ে কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং-এর মতো পদক্ষেপ নিলেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। গ্রিস, পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন ও আয়ারল্যান্ড কয়েক দফা বেলআউট নিয়ে দেউলিয়ার ঝুঁকি থেকে সাময়িকের জন্য রক্ষা পেলেও ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। সঙ্গে যোগ হয়েছে ইউরো গ্রুপের চাপিয়ে দেওয়া কৃচ্ছ্রসাধনের বাধ্যবাধকতা। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও ব্যাপক বেকারত্ব। গ্রিস, ফিনল্যান্ডেরে জিডিপি এখনো ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। ইতালি, ফ্রান্স ও পর্তুগালের অর্থনীতি দৃশ্যত স্থবিরতায় ভুগছে। গত পাঁচ বছরে ইউরোজোনের গড় জিডিপি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশেরও কম। একদিকে বিপুল ঋণের বোঝা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সমস্যা। বিশেষ করে গ্রিসের বামপন্থী সরকারের সঙ্গে ইউরো গ্রুপের দ্বন্দ্ব কিছু সময়ের জন্য প্রশমিত হলেও স্পেন, পর্তুগালে বামপন্থী দলগুলো ইউরো গ্রুপকে নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে।
গত বছরের গ্রেগশিটের ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রেগশিটের ঝুঁকি। আগামী ২৩ জুন গণভোটের মাধ্যমে ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না-থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। ব্রিটেন বা গ্রিস যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, আয়ারল্যান্ডও একই পথ অনুসরণ করতে পারে। এমনটি হলে একক মুদ্রাব্যবস্থার পতন অনিবার্য। ভিন্নভাবে বললে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমাপ্তি।
প্রশ্ন হচ্ছে, তিন মহাদেশের চলমান সংকটের সর্বশেষ পরিণতি কী হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতিবিদরা ভিন্ন মত প্রকাশ করলেও নৌরিয়েল রুবিনি, ডেভিড লেভি, রাঘুরাম রাজন—যাঁরা ২০০৭-০৮-এর মহামন্দার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাঁরা সবাই একমত। এই তারকা অর্থনীতিবিদদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় এড়ানোর সুযোগ নেই। নৌরিয়েল রুবিনি ও ডেইভিড লেভি সময় উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১৬-১৭ সালের মধ্যে বিশ্ব আরেকটি মহামন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি একধাপ এগিয়ে বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। পিকেটির মন্তব্যটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের জন্য অস্বস্তিকর হলেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অক্ষত রেখে চলমান সংকটের টেকসই কোনো সমাধান কেউ বাতলে দিতে পারছে না। আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টিন ল্যাগার্দ বিভিন্ন আলোচনায় ‘বিশ্ব অর্থনীতির পুনঃস্থাপন’-এর কথা উল্লেখ করলেও স্পষ্ট কোনো কাঠামো এখন পর্যন্ত উপস্থাপন করেননি। মিস ল্যাগার্দের উল্লেখিত ‘পুনঃস্থাপন’ যদি নতুন অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা হয়, তাহলে আমরা খুব সম্ভবত ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
আশফাক রনি, লন্ডন