প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস মৎস্য সম্পদকে এগিয়ে নিতে হবে

গত ১৯-২৫ জুলাই ২০১৬ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে এ বছরের মৎস্য সপ্তাহ। এ উপলক্ষে ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে মাছের পোনা অবমুক্ত করে মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন করেছেন। এবারের মৎস্য সপ্তাহের স্লোগান ও প্রতিপাদ্য হলো, ‘জল যেখানে, মাছ সেখানে’। আমরা একটি কথা বেদবাক্যের মতো সবাই জানি যে, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মাছ একটি কমন আমিষ। তাই মাছ আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। খাদ্যের যে ছয়টি উপাদান রয়েছে, আমিষ তার মধ্যে অন্যতম। আর আমিষের মধ্যে আবার উদ্ভিজ, প্রাণিজ ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। তার মধ্যে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হলো মাছ। এ মাছ প্রাণিজ আমিষের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ পূরণ করে থাকে। আমাদের দেশে মাছের বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ হলো ৪২ থেকে ৪৩ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। উক্ত ৩৬ লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে চাষ করা মাছ হচ্ছে ২০ লাখ মেট্রিক টন এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত হচ্ছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। আশির দশক থেকে দেশে মূলত মাছের আবাদ শুরু হয়েছে। তার আগপর্যন্ত মাছের পুরোটাই প্রাকৃতিকভাবে সংগ্রহ করা হতো। বিগত তিন দশকে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে মাছের চাহিদা ও জোগান। কাজেই একটি কথা আমরা অতি সহজেই বলতে পারি, এ সময়ের মধ্যে যদি দেশে মাছের আবাদ করা না হতো তাহলে বর্তমান চাহিদার বিপরীতে মাছের যে উৎপাদন হতো, তা মাত্র তিন ভাগের একভাগ। অথচ আজ আমরা বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য মাছের চাহিদা মেটানোর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি।
এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদনে আমাদের দেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের পরপরই আমাদের অবস্থান। মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের একটি গর্বের বিষয় এই যে, আয়তনে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও তার মৎস্য উৎপাদন ৩৬ লাখ টন, যেখানে থাইল্যান্ড ৭৮ লাখ, ভারত ৫২ লাখ টন কিংবা চীনের ৫০ লাখ টন উৎপাদন করে থাকে। দেশে মিঠাপানির কমপক্ষে ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় তাদের অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তির পথে। মিঠাপানির মাছ চাষের পরিসীমা আর হয়তো খুব বেশি বাড়ানো সম্ভব নয়। কারণ প্রতিমুহূর্তেই বসতবাড়িসহ বিভিন্ন অবকাঠামো হয়ে জায়গাজমি দখল হয়ে যাচ্ছে এবং আর কোনো কৃষিজমি মৎস্য খাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। সে জন্য মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য স্বাদুপানির মাছ চাষ বাড়ানোর তেমন কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে আমাদের দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিজয় অর্জিত হয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার জলসীমা এখন বাংলাদেশের অন্তর্গত।
এখন আমাদের সুযোগ রয়েছে সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য ব্লু ইকোনমি হিসেবে পরিচিত দ্বি-স্তরবিশিষ্ট হিসেবে অভিযান চালানো। কারণ সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে বিশ্বে আমরা ২৫তম অবস্থানে, যা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। তবে দেশে বর্তমানে এ বিপুল পরিমাণ মৎস্য উপাদনের কৃতিত্ব একমাত্র মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের। তারা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের এ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করছেন। এতে যে শুধু মৎস্য উৎপাদনেই দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে তাই নয়। এ খাতে মোট জনসংখ্যার ১১ ভাগ লোকেরও সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে চাকরিপ্রার্থী অনেক তরুণ ও যুবকের। মৎস্যবিজ্ঞানীরা আজ দেশীয় অনেক মাছসহ বিদেশি অনেক মাছকে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন। যে কারণে ইলিশ ছাড়া এখন প্রায় সব ধরনের মাছই পুকুরে কিংবা মুক্ত জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবাদ করা হচ্ছে।
এভাবে গবেষণাকাজ চলতে থাকলে এ কাজ বেশি দূরে নয়, যেদিন হয়তো ইলিশ মাছও পুকুরে আবাদ করতে শোনা যাবে। তা ছাড়া দেশের মৎস্যসম্পদের চাহিদা পূরণের জন্য বাকি যে পাঁচ-সাত লাখ টন মাছ উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন, সমুদ্রের মৎস্য আহরণের জন্য আগামী নভেম্বর মাস থেকে পরিচালিত যৌথ অভিযানের মাধ্যমে তাতে সামনের বছরগুলোতে তা পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে আরেকটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে বলেছেন যে, সাম্প্রতিককালে চিংড়ি মাছ রপ্তানির সময় তার ওজন বাড়ানোর জন্য একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মাছের ভেতরে তারকাঁটা বা লোহা ঢুকিয়ে দিয়েছেন যা বিদেশে আমাদের দেশের রপ্তানি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। কাজেই বিদেশে প্রায় শতকোটি ডলালের যে ইলিশ এবং চিংড়িসহ অন্যান্য ফ্রোজেন ফুড পাঠানো হয়, তাকে কোনো অবস্থাতেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। ১৯-২৫ জুলাই দেশে পালিত মৎস্য সপ্তাহের এটাই হোক সবার প্রত্যাশা।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়