অভিবাসী শ্রমিক
পররাষ্ট্রের লোভ, রাষ্ট্রের দায়
অভিবাসী শ্রমিকরা সভ্যতার এক আশ্চর্য জ্বালানি। কিন্তু বেআইনি দেশান্তরী শ্রমিকরা তাদের মাঝেও বিশেষভাবে অনন্য। এদের তুমি সবচেয়ে কম পয়সায় খাটাতে পারবে। এদের জীবন-নিরাপত্তা-জীবিকার আইনি নিশ্চয়তা থাকবে সবচেয়ে কম এবং সেসব কারণে কিংবা অকারণে যে কোনো বদনাম এদের গায়ে সেঁটে দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে পালে পালে আটকে রাখতে পারবে বন্দিশিবিরে কিংবা কারাগারে। খেদিয়ে দিতে পারবে দেশ থেকে। শূন্যস্থান দখল করতে যারা ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে সাগরে, তাদের জন্যও বিরাট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে আগেকার লোকদের পরিণতি। তারপরও ঝামেলা সর্বদা এড়ানো যায় না, বৈধ কিংবা অবৈধ অভিবাসীদের মানবেতর জীবন, অমর্যাদা আর অনিশ্চয়তার সংবাদ টাকাওয়ালা কিংবা হবু টাকাওয়ালা দেশগুলোর জন্য প্রায়ই বিড়ম্বনা ডেকে আনে।
বিড়ম্বনা আর মুনাফা দাড়িপাল্লায় মাপলে কোনটার ওজন বেশি হবে, সেটা সবাই খুব ভালো করে জানে। ফলে মুনাফা কামাতে যদি বিড়ম্বনা এড়াবার উপায় আদৌ না থাকে, বিড়ম্বনা-ব্যবস্থাপনার অজস্র পদ্ধতি তো আছেই। অভিবাসী শ্রমিক বিষয়টা নিয়ে এভাবেই আসলে চলছে বহু শতাব্দীজুড়েই। আমরা সাধারণত শুধু দেখতে পাই ধনী দেশে যাওয়ার জন্য গরিব দেশের মানুষের বেপরোয়া আকুতি, বান কি মুন নামের ভদ্রলোকটি সেটাকেই গালভরা বাক্যে প্রকাশ করেছেন : ‘অভিবাসন হলো মর্যাদা, নিরাপত্তা আর সুন্দরতর ভবিষ্যতের জন্য মানব আকাঙ্ক্ষার একটা প্রকাশ। এটা সামাজিক বুননের একটা অংশ, অংশ একটা মানব পরিবার হিসেবে আমাদের গঠনেরও।’
১.
কিন্তু শত শত বছর ধরে! হুম, অন্তত শিল্প বিপ্লবের শুরুর অব্যবহিত পর থেকেই এটা প্রধান প্রবণতা হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিক বিকাশের ফলে ভাড়াটে শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি অস্থানীয় সস্তা শ্রমিককে টেনে আনতে প্রলুদ্ধ বা অপারগতায় দাস হতে বাধ্য করেছে। ধরুন না, আজ থেকে ১১০ বছর আগে, ১৯০৬ সালে মার্কিন এক ধনকুবেরের সাথে কাল্পনিক একটা সাক্ষাৎকারের বিবরণীতে ম্যাকসিম গোর্কি লিখছেন,
“সর্বনাশ? চোখ দুটো বিস্ফোরিত করে সে আওড়াল। ‘সর্বনাশ তখনই যখন শ্রমের দাম বেশি। যখন ধর্মঘট হয়। কিন্তু আমাদের এখানে আছে অন্য দেশ থেকে এখানে যারা বসবাসের জন্য আসছে, সেই দেশান্তরীর দল। তাদের কল্যাণে শ্রমিকদের মজুরি সব সময় নিচের দিকে থাকে, ধর্মঘটীদের জায়গায় কাজ করার জন্য তারা মুখিয়ে আছে। দেশে যখন এই রকম লোক যথেষ্ট পরিমাণে এসে জুটবে, যারা শস্তায় কাজ করবে এবং কিনবে অনেক, তখন সব ভালো চলবে।‘ (পীত দানবের পুরী, অনুবাদ অরুণ সোম)
গোর্কির দেখা মার্কিন মুল্লুকের এই চিত্রটির অনুষঙ্গগুলোর এদিক সেদিক হয়েছে, কিন্তু দেশান্তরী শ্রমিকের ভাগ্যের কোনো রদবদল নেই। মার্কিন শিল্প খাত গড়ে ওঠার জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে ল্যাতিনো, মেক্সিকান আর কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের দেহ। কিন্তু বিনিময়ে কিছু চাইতে গেলে জুটত গুন্ডাবাহিনীর অত্যাচার, পুলিশি দমন, জেল, গুপ্তহত্যা, এমনকি সেনাবাহিনীরও গোলা। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরা দাসব্যবস্থা-পরবর্তী সময়েও বিশেষ নিপীড়ন ও অধিকারহীনতার শিকার হয়েছেন। স্বদেশি নাগরিকদের ওপরও এগুলোর ব্যবহারের কমতি নেই ইতিহাসে, কিন্তু নাগরিক অধিকার নেই এমন মানুষদের ওপর এসবের প্রয়োগ তুলনামূলকভাবে সহজতর।
সস্তা শ্রমিক বিদেশ থেকে আমদানির সুবিধার একটা দিক যেমন প্রায় দাসশ্রমে কাজ চালানো যায়, তেমনি দেশের শ্রমিকদেরও মজুরির লাগাম টেনে রাখা যায়। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের বিকাশের আগের পর্বে দেশজ শ্রমিকদের সাথে বহিরাগত শ্রমিকদের রেষারেষি ছিল নিত্যকার ঘটনা, প্রায়ই তা দাঙ্গার পর্যায়েও পৌঁছাত। সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের বিকাশের একটা পর্যায়ে ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনের এই শিক্ষাটা হলো যে, প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার স্বীকার করে নিলেই বরং মালিকপক্ষের এই ফাঁদটা থেকে কার্যকরভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। না হলে বহিরাগত শ্রমিকদের ব্যবহার করে মালিক শ্রমের মূল্য কমিয়ে ফেলে, কাজের পরিবেশের নিরাপত্তা নিয়েও গাফিলতির সুযোগ পায়। খুব চরম রকম প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে এই রেষারেষিটা কমবেশি বজায় আছে, আর তা জন্ম দেয় নানা রকম রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর হিসাব নিকাশের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজও দেখা যাবে অবৈধ অভিবাসীদের শ্রমকে পানির দরে শোষণের যেমন বন্দোবস্ত, অন্যদিকে অভিবাসীদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিদ্বেষকে পুঁজি করে নানা রকম ডানপন্থী বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী রাজনীতির বিকাশ।
৩.
কিন্তু কারা অভিবাসী হয়? দেশত্যাগ কেন করে মানুষ?
দেশত্যাগের একটা আদিম কারণ খাদ্যের অভাব। নিজের ভূমি উদ্বৃত্ত জনগোষ্ঠীকে আর পোষণ করতে পারে না তেমন সব সময়ে সব জাতিতেই বাধ্যতামূলক দেশত্যাগের বন্দোবস্ত থাকত। প্রাচীন আর্য, সেমেটিক, গ্রিক, রোমান, জার্মান, জাতিগুলোতে দেখা যাবে বসতি স্থাপনকারীদের নেতৃত্বে নতুন নতুন জনপদের প্রতিষ্ঠা। ইতিহাস বিখ্যাত কার্থেজ নগরীটি ছিল সেমেটিকজাত একটি ফোনেশিয় উপনিবেশ, এশিয়া মাইনরে ছিল অজস্র গ্রিক উপনিবেশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদি নগরীটির সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বজায় রাখত তারা, গ্রিক ভাষায় সেটিকে বলা হতো মেট্রোপলিস, বাংলায় হবে মাতৃনগরী। কলোনি শব্দটা রোমান ভাষা থেকে এসেছে, আদি একটা অর্থ চাষা। কোলন নগরীটি সেই ভাবার্থটি আজও বহন করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের অভাবের পাশাপাশি আরেকটা কারণ ছিল যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হওয়া। তখন বিকল্প হতো দুর্বলতর কোনো জাতির ভূমি দখলের চেষ্টা অথবা একদম নতুন পত্তনির সন্ধান। প্রাচীন ইতিহাসে অজস্র নতুন সাম্রাজ্য ও রাজবংশ সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। প্রাচীন ইতিহাসের আরেকটা অভিবাসন হতো দাসদের। প্রথমদিকে যুদ্ধে পরাজিত জাতিগুলো দাসে পরিণত হতো, পরে দাসের চাহিদা ও বাজার বৃদ্ধি পেলে দাসের প্রয়োজনেই নিত্যনতুন অভিযানের আয়োজন করা হয়। মেসোপটেমিয়, মিসরীয়, রোমান, গ্রিক সভ্যতায় স্রেফ দাসের সন্ধানে অজস্র যুদ্ধের ইতিহাস আছে। অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার দাসব্যবস্থাই ছিল বলে এ জন্য এই যুগটাকে ইতিহাসে দাসযুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মধ্যযুগে দাস ব্যবসার জন্য পরিচিত ছিল আফ্রিকার আরব সওদাগররা। সৌদি আরব আর ইয়েমেনে মাত্র গত শতকের মধ্যভাগে ১৯৬২ সালে দাস ব্যবসা আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। আধুনিক কালের সূচনালগ্নে ইউরোপের নগরায়নের চাহিদা মেটাতে আফ্রিকা থেকে বিপুল দাস আনা শুরু হয় ষোল শতকের শুরুতে, অগ্রবর্তী ছিল পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ ব্যবসায়ীরা। অচিরেই ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের আখের খামারগুলো ‘শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়ে’ ভরে উঠতে থাকে। চিনি ছিল শিল্পবিপ্লবের শুরুর দিকে পৃথিবীর সবচে লাভজনক উৎপাদনগুলোর একটি, আর তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসের অমানবিকতম দাসব্যবস্থা।
খাদ্যের বা কর্মসংস্থানের অভাবে দেশের বাইরে কাজ খুঁজতে বাধ্য হওয়ার আধুনিককালে প্রথম সবচে বড় উদাহরণ আইরিশ জাতি। দখলদার ব্রিটিশদের অত্যাচারে প্রতিবেশী আইরিশরা উনিশ শতকে ভয়াবহ সব দুর্ভিক্ষের শিকার হন। এই মানুষগুলোকে লাখে লাখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়, প্রধান গন্তব্য হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া আইরিশ মজুররা ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে সস্তা শ্রমিক হিসেবে যাযাবর মজুর হিসেবে কাজ করতেন। জমিদার বা বড় কৃষকরা স্থানীয় কৃষকদের নিয়োগ না দিয়ে আইরিশ মজুরদের ব্যবহার করত। আইরিশদের শারীরিক গঠন ব্রিটিশদের তুলনায় দুর্বলতর হলেও মজুরি তারা এত কম নিত যে বাষ্পীয় পোতে যাতায়াতের খরচার পরও তা খরচায় পোষাত। রেলগাড়ি আসার পর এই আইরিশ কৃষকদের আগমনের হার আরো দ্রুত বাড়তে থাকল। কাজবঞ্চিত ব্রিটিশ কৃষিশ্রমিকরা দল বেঁধে হামলা চালাত আইরিশদের ওপর, দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুনোখুনি প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়। দাঙ্গার মুহূর্তগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনি কর্তারা আইরিশদের রক্ষায় সামান্য ব্যবস্থাই নিত, কেননা তাতে দাঁড়াতে হতো স্বদেশি ভোটারদের বিরুদ্ধে। বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর এবং জটিল। ব্রিটিশ নিয়োগকর্তারা স্বদেশি শ্রমিকদের চেয়ে আইরিশ চাষিদের নিয়োগ করতে পারলেই বেশি খুশি হতো। ফসল কাটার সময়ে আইরিশদের বহন করতে একদিকে রেলগাড়িতে বাড়তি খোলা কামরা জুড়ে দেওয়া হতো, অন্যদিকে ক্ষুব্ধ ব্রিটিশদের তাদের ওপর পাথড় ছুড়ে মারাটাও ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। ১৮৫০-এর আশপাশের সনগুলোতে বছরপ্রতি দুই তিন লাখ করে আইরিশভাষীর কাজের সন্ধানে ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগেই লিভারপুলের মতো বড় বড় নগরেও বিশাল সব আইরিশ বসতি গড়ে ওঠে, জাহাজ নির্মাণের মতো শিল্পে তারা ইংরেজ শ্রমিকদের হটিয়ে দেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে তাদের মারামারি-দাঙ্গা-রেশারেশি ইতিহাসবিশ্রুত। মালিকরাও এই বিভাজনে উৎসাহ দিতেন। ইংরেজ শ্রমিকদের ধর্মঘট ভাঙাতে আইরিশ মজুরদের ব্যবহার ঘটেছে, মজুরি কমিয়ে রাখার জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্থানে আন্তর্জাতিকতাবাদী শ্রমিকভ্রাতৃত্বের বোধ জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়ায় এর কিছুটা অবসান ঘটলেও পুরোপুরি নির্মূল তা হয়নি। অভিবাসী শ্রমিকরা ইংল্যান্ডের ইংলিশ চরিত্র বা স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে বলে যারা মনস্তাপে ভোগেন, এই তারা কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারেন এই ভেবে যে, স্থিতিশীল বলে কিছু আসলে নেই। ইংল্যান্ডেরও ইতিহাস এই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংঘাতেরই বিকাশ। এর প্রধান দায় সস্তা শ্রমের লোভে যে এই শ্রমিকদের একদিকে প্রলুব্ধ করেছে, অন্যদিকে তাদের স্বদেশে থাকাটাকেই কঠিন করে দিয়েছে।
৪.
কিন্তু অন্য একটি দিকেও মনোযোগ দেওয়া দরকার, প্রাচীন পৃথিবীর দেশান্তর ঘটত প্রধানত চাষযোগ্য জমির অভাবে। উনিশ শতকেই প্রথমবারের মতো দেশান্তরী হওয়ার নতুন এবং সম্পূর্ণ বিপরীত একটা কারণও পাওয়া গেল : অতি-উৎপাদন। পরাধীন, দুর্ভিক্ষপীড়িত, দুঃশাসনের শিকার আইরিশদের মতো না হলেও দৃষ্টিগ্রাহ্য হারে দেশত্যাগে বাধ্য হতো স্বয়ং ব্রিটিশরাও।
১৮৪৭-১৮৫২ সালের মাঝে প্রায় ১২ লাখ আইরিশ যুক্তরাজ্য ত্যাগ করে। এই পাঁচ বছরেই প্রায় সাড়ে তিন লাখ ব্রিটিশও অভিবাসী হয়ে যুক্তরাজ্য ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ঋণগ্রস্ত, ভবিষ্যতের বিষয়ে নৈরাশ্যগ্রস্ত ছোট কৃষকরাই, বিশেষ করে এই দেশত্যাগীদের দলে ভিড় জমায়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় তারা যায় মার্কিন মুল্লুকে, তখনো অনাবাদি বিশাল দেশটায় নতুন নতুন আবাদ গড়ে তুলতে। অথচ এই সময়গুলো ব্রিটিশ উৎপাদকদের শনৈঃ শনৈঃ বিকাশের যুগ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস প্রথম থেকেই যথেষ্ট জাতিবিদ্বেষী। ইংরেজ ও আইরিশরা সেখানে ভাগ্য গড়ে তোলার সুযোগ পেলেও উনিশ শতকে অন্যান্য জাতির সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো, বলা উচিত যে অন্য জাতিভুক্ত মানুষের কোনো ন্যূনতম আইনগত অধিকার তারা দিত না। ব্রিটিশ জাহাজের বয়লার রুমের অত্যাচার সহ্য করতে না পারা বাঙালি নাবিকরা সেখানে কী রকম প্রতিকূলতা আর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন, তার বিবরণ সংবলিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ‘বেঙ্গলি হার্লেম অ্যান্ড দ্য লস্ট হিস্টরিজ অব সাউথ এশিয়ান আমেরিকা’ নামে। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ, কিংবা অভিবাসী পশ্চিম ভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীতে বিয়েশাদি করেভি এই বাঙালি অভিবাসী জনগোষ্ঠী মার্কিন স্রোতের মূলধারা থেকে নিজেদের প্রায় অদৃশ্য করে অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। মাতৃভূমির সাথে উত্তরসূরিদের যোগাযোগ না থাকলেও তাদের স্বতন্ত্র একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী পাঞ্জাবি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ‘লিঞ্চ’ বা ‘ঝুলিয়ে দেওয়া’ হরদম ঘটত। রেললাইন নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহার করা হয়েছে সস্তায় বিপুল চীনা শ্রমিক। এদের বড় অংশই আফিম-যুদ্ধের পরবর্তী বিপর্যস্ত সময়ে চীন ত্যাগে বাধ্য হয়েছে, প্রধানত তারা ছিল কৃষক ও কারিগর শ্রেণির মানুষ। কৃষ্ণাঙ্গদের পর এরাই সবচেয়ে বেশি বর্ণবাদী আইন ও সামাজিক বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
বাঙালিদের বাইরে অভিবাসন এবং বাংলায় বিদেশিদের অভিবাসনের পরিমাণ কিন্তু খুব কম না। অস্ট্রেলিয়ায় মরুভূমিতে পরিবহনের জন্য একদা রাজস্থান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উট, আর আফগানিস্তান থেকে উটচালক। হালে জানা যাচ্ছে, আফগান নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীতে বাঙালিরাও ছিলেন। বাঙালি বংশোদ্ভূদ একজন অস্ট্রেলীয়য় গবেষক উনিশ শতকে নির্মিত অস্ট্রেলিয়ার আদিতম মসজিদ থেকে আবিষ্কার করেছেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটা বাংলা পুস্তক। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে মরিসাসে, আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে। এমনকি মালয়েশিয়াতেও বেশ বড়সড় একটা জনগোষ্ঠীর পূর্বসূরি বাঙালি ও অন্যান্য ভারতীয় মানুষজন, আঠারো আর উনিশ শতকে ব্রিটিশরা তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল নানা দাপ্তরিক কাজকর্ম, কুলি, ব্যবসায়ী, পুলিশ আর সৈনিকের কাজ করার জন্য।
আড়কাঠি শব্দটা একদা বাংলা সন্নিহিত অঞ্চলে ও সাহিত্যে খুব পরিচিত ছিল। এই আড়কাঠিদের কাজ ছিল ভাগ্যপীড়িত ব্যক্তি কিংবা কখনো কখনো আস্ত গোষ্ঠীকে ফুসলিয়ে বিদেশ-বিভূইয়ে যেতে রাজি করানো, বিনিময়ে দালালি বাবদ মালিকদের কাছ থেকে জুটত ভালো অঙ্কের টাকা। বাংলায় শেষ বড় অভিবাসনগুলো হয়েছে সস্তা শ্রম ও সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য পেশাগুলোর কল্যাণেই। অনাবাদি জমিকে আবাদি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে, তারপর তাদের বারংবার উচ্ছেদ করে নতুন আরেকখানে বসানো হয়েছে। চা বাগান আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবেও বেশকটি জনগোষ্ঠীর মানুষকে বাংলা ও আসামে নিয়ে আসা হয়েছে। ‘চল মিনি আসাম যাব, দেশে বড় দুঃখ রে..,’ গানটি আড়কাঠির পাল্লায় পড়া এক অভিবাসীর চিরকালের দুঃখের প্রতিচ্ছবি।
৫.
থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার উপকূলে ভাসমান মানুষগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় কম কথা হলো না। সমুদ্রে ভাসমান মানুষগুলো অবৈধ, স্রেফ এই সুবিধাটুকু নিয়ে থাইল্যান্ড বিশ্বের কাছে আড়াল করে রাখল এই সস্তা শ্রমিকদের সেই লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে দেশটির মৎস্যশিল্পের মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য। প্রায় দাসশ্রমের পরিস্থিতিতে কাজ করা এই মানুষগুলোর বর্ণনা আর নতুন করে না দেই, কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার এটা থাই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতাতেই চলেছে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ১০ জুন, ২০১৪ সালে Revealed: Asian slave labour producing prawns for supermarkets in US, UK শীর্ষক সংবাদটিতে উল্লেখ করা হয়েছে এই দাসশ্রমের কথা। এক বছর আগের এই প্রতিবেদনে প্রায় তিন লাখ দাসশ্রমের যুক্ত থাকার কথা বলা আছে, যাদেরকে ২০ ঘণ্টা দৈনিক কাজ করানো হয়, প্রতিবাদ করলে বেধড়ক পিটুনি শুধু নয়, হত্যাও করা হয়। অনেকেই ডাঙ্গায় ওঠার সুযোগই পায় না বছরের পর বছর, একটানা কাজ করার জন্য তাদের মাদক সেবনও করানো হয়।
কিন্তু ওই প্রতিবেদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এ্ই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো ভূমিকা নিতে থাই সরকারের পরিষ্কার অনিচ্ছার সংবাদটি। মুখে তারা দাসশ্রম নিরোধকে অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করলেও এটা বন্ধ করার কোনো আইনগত কিংবা কাঠামোগত কোনো পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়নি। নিয়োগদান প্রক্রিয়াকে আইনসঙ্গত করা হলেই পরিস্থিতির বড় বদল হতো, কিন্তু তাতে নিয়োগকৃত শ্রমিককে একটানা কাজ আর করানো যেত না। দিতে হতো কিছুটা বাড়তি মজুরি, পরিবারের সাথে যোগাযোগের সুযোগ এবং নিরাপত্তা। যতদিন সম্ভব, এই বর্বর পরিস্থিতি যে থাই সরকার বহাল রাখবে, তাতে আর সন্দেহ কি, মৎস্য রফতানি থাইল্যান্ডের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার খাত যে!
ফলে বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল বহু আগেই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর শ্রমনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বিষয়টা তোলা। যে পরিমাণ শ্রমিক তাদের লাগবে মোটামুটি সেই পরিমাণ শ্রমিক যেন তারা বৈধপথেই, সম্ভব হলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই নিয়োজিত করার বন্দোবস্ত করে, সেই বিষয়টি আলোচনায় রাখা। সেটা বাংলাদেশ কখনো করেনি, বরং এই পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটতে দিয়েছে, এবং বলা যায় এখনো এই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা অবশ্য বাংলাদেশের শাসকদের চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও। ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বহু দেশ যখন মধ্যপ্রাচ্যে নারীশ্রমিকদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদে সেখানে গৃহপরিচারিকা পাঠানো বন্ধ করেছে, বাংলাদেশ তখন সোৎসাহে মাত্র ১৫ হাজার মাসকাবারি চুক্তিতে কোনো আইনি প্রতিরক্ষা ছাড়া তাদের পাঠানোর চুক্তি করে উল্লাস প্রকাশ করছে।
দ্বিতীয়ত, এই দাসবাজারে মানুষকে ফুসলিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে যে মানবপাচারের জালের জন্ম হয়, তারই অনুসঙ্গ বন্দিশিবির, মুক্তিপণ আদায়। এই বিষয়টাও বাংলাদেশ সরকারের অজানা থাকার কোনো কারণ নেই। মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে মানুষজনকে থাইল্যান্ডে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, মুক্তিপণ না দিতে পারলে অন্তত চার বছর দাসশ্রম দিতে বাধ্য করার গা শিউরানো সংবাদ ৭ ডিসেম্বর ২০১২-তে প্রথম আলোর ‘থাইল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছেই লাখ টাকার মুক্তিপণ’ নামের সংবাদে পাওয়া যাবে। যাঁরা ওই মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেন, তাঁদের পৌঁছে দেওয়া হতো মালয়েশিয়ায়। অপারগতায় থাই মাছধরা নৌকোতে দাসশ্রম।
কদিন আগে ‘আদমপাচারের চেষ্টার সময়ে’ ক্রসফায়ারে নিহত জাফর মাঝির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রথম আলো বলছে এক একটা দফার সফল মানবপাচারের পরে তিনি কয়েক লাখ টাকা পেতেন। বোঝাই যায় সামান্য মাঝি কয়েক লাখ টাকা পেলে যাদের ছত্রছায়ায় এসব চলে তারা কত আয় করেন। বছরে লাখ খানেক মানুষ যদি টেকনাফ-কক্সবাজার উপকূল দিয়ে পাচার হয়, তাহলে এই অর্থনীতির আকৃতি দাঁড়াবে অবিশ্বাস্য বিশাল। কীভাবে সম্ভব বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ মানুষের এই পাচার পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড আর নৌবাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে চলা? দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জনপ্রতিনিধিদের বিনা অনুমতিতে এসব হতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। এর সাথে ক্রসফায়ারের কোনো সম্পর্ক নেই- এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন? এই ভয়াবহ বিয়োগান্তক নাটকে আধুনিক দাসব্যবসার আধুনিক আড়কাঠির ভূমিকায় কারা কারা অভিনয় করেছে, সেটা দেশবাসীর সামনে খানিকটা স্পষ্ট করে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কার হওয়া থাইল্যান্ডের গণকবরগুলো।
থাইল্যান্ডের মৎস্যশিল্পের তুলনায় পরিস্থিতি একটু ভালো হলেও মালয়েশিয়ার অতীত ও বর্তমান কাজের পরিস্থিতিও খুব আকর্ষণীয় নয়। বর্তমান অভিবাসী শ্রমিক সংকটটি যে শ্রমবাজারকে কেন্দ্র করে, সেই মালয়েশিয়ার শ্রমনীতিই আসলে বর্তমান সংকটের অন্যতম উৎস। ইন্টারন্যাশলাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনটি বলছে যে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে খারাপ শ্রমপরিবেশের দেশগুলোর একটি মালয়েশিয়া। এই তালিকাতে এরচেয়ে নিকৃষ্টতর স্থান পেয়েছে কেবলমাত্র সামরিক শাসন বা যুদ্ধপরিস্থিতি থাকা দেশগুলো। মালয়েশিয়ারসহ এই তালিকাভুক্ত দেশগুলোতে শ্রমপরিবেশের কোনো নিশ্চয়তা নেই কিংবা নামমাত্র আইনগত কিছু প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। নব্য শিল্পায়িত এই দেশগুলোর মাঝে মালয়েশিয়াই সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, নানা প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া সরকার বৈধ শ্রমিকদের চেয়ে অবৈধ শ্রমিকদের নিয়োগে পরোক্ষ কিন্তু কার্যকর উৎসাহ দিচ্ছে। কৃষিশ্রমিকদের বড় অংশ, গৃহস্থালি শ্রমিকদের বিশাল অংশ এবং কোনো কোনো শিল্পেও অবৈধ শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয়। মুখে আরেক কথা বললেও মালয়েশিয়া সরকারই এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে। কেননা এর সুবিধা হলো এরা কোনো আইনগত অধিকার পায় না, কম মজুরিতে এদের নিয়োগ করা যায়, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না থাকায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবৈধ শ্রমিকদের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে চাপ কম হয়। যে কোনো সময়ে এদেরকে বহিষ্কার ও শাস্তি দেওয়া যায়, এদের ওপর আইনি নিপীড়ন চলে ব্যাপক। যে কোনো বিপদের মুহূর্তে এদেরকে বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করে তার দায়দায়িত্বও অভিবাসীদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া যায়। এত সব সুবিধার কারণেই নানা টালবাহানায় বৈধপথে শ্রমিক আমদানি বন্ধ রেখে অবৈধ পথে তাদের আনার উৎসাহ দেওয়া হয়।
৬.
কিন্তু মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডকে এত গোনাগুনতির কী আছে? কেন বাংলাদেশ সরকার সব কিছু জেনেও চুপ করে থাকে? তারা কি বাংলাদেশকে কোনোভাবে বিপদে ফেলবে? বাংলাদেশের শ্রমিক ছাড়া মালয়েশিয়া অচল থাকবে, থাইল্যান্ডের মাছ আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে। বৈধপথে শ্রমিক রফতানি শূন্যের কোঠায় চলে যাওয়ার পরও সেখানে যে বিপুল পরিমাণ মানুষ যাচ্ছে, সেটাই তাদের গোপন চাহিদাকে তুলে ধরে। তাদের কাছ থেকে আমরা বহুগুণ বেশি পণ্যও আমদানি করি। বাংলাদেশের চেয়ে বহু দরিদ্র দেশের মানুষও এত খারাপ শ্রম-পরিবেশে কাজ করবে না। আফগান বা আফ্রিকান অধিকাংশ দেশের শ্রমিকরা স্রেফ খুন কিংবা দাঙ্গা বাধিয়ে দেবে। আসলে এসব ক্ষেত্রে কে কাকে সমঝে চলবে, তা নির্ভর করে শাসকদের সংস্কৃতি আর লোভের ওপরই। দাসশ্রম রফতানিতে যদি লুটেরারা পকেট ভরতে পারে, সে দেশবাসীকে দাসশ্রমেই ঠেলে দেবে এবং দাসমালিকের প্রতিই নমো নমো করবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক দূতাবাসের কর্মীরা স্বদেশি বৈধ শ্রমিকদেরও সহায়তা করে না, বরং বিদেশি মালিকদেরই স্বার্থ রক্ষা করে—এমন একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। পৃথিবীর মাঝে বাংলাদেশই অল্প কটি ব্যতিক্রমের একটি যেখানে প্রবাসী শ্রমিকদের সাথে দূতাবাসে কল্পনাতীত রকমের অপমানজনক ব্যবহার করা হয়। নগদ স্বার্থের বন্ধনই এই বাস্তবতার জন্ম দেয়। বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য এটা এমন একটা বাস্তবতা, যেখানে তার শাসকরাই অপরপক্ষের হয়ে আড়কাঠির ভূমিকা নিয়েছে।
৭.
এটাও ভাবা দরকার, কেন বিপুলসংখ্যক তরুণ সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছেন, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মালবাহী ট্রাকে কিংবা জাহাজের খোলে মৃত্যুবরণ করছেন, অজানা সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন। একজন জ্যেষ্ঠ অভিবাসী বিশেষজ্ঞ দেখলাম লিখেছেন রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে এর সূত্রপাত। এটা সম্ভবত সঠিক না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিক আছে পাকিস্তানের করাচি নগরে, প্রধানত মৎস্যজীবী হিসেবেই। তাদের সংখ্যা ১০ লাখের অনেক বেশি এবং তাদের বড় অংশই আশি ও নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে গিয়েছেন। ভারতের শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি যুক্ত আছেন। অন্তত এখন যখন আমরা জানছি যে প্রায় ৪১টি জেলা থেকে মানুষ থাইল্যান্ডে নিয়মিত মানুষ পাচার হয়।
মানবপাচারের শিকারদের মাঝে মফঃস্বল আর গ্রামের মানুষদের আধিক্য একটা সহজ বিষয়ে আমাদের চোখে আঙুল দেখিয়ে দেয়। সেটা হলো গ্রামীণ অর্থনীতির ধারণ-অক্ষমতা। এই যে বলা হলো, বাংলাদেশ সরকার পরের স্বার্থের আড়কাঠির ভূমিকা পালন করে, এ বছরই তার একটা নমুনা দেখা যাবে ভারত থেকে চাল আমদানির বেলায়। দুনিয়াজুড়েই এ বছর চালের উৎপাদনে রমরমা, অতি-উৎপাদনের কারণে ফসলের দাম হুমকির মুখে। প্রতিবেশী সরকারগুলোও যখন এমন পরিস্থিতিতে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার তখন রাতারাতি ভারতীয় চাল আমদানির বন্দোবস্ত করে দিলো শূন্য শুল্কে। নিন্দার মুখে সামান্য ১০ ভাগ কর বসানো হলো বটে, ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। বাজার ছেয়ে গেল ভর্তুকি পাওয়া ভারতীয় সস্তা চালে। বাংলাদেশ সরকার যেন প্রতিনিধিত্ব করলেন ভারতীয় কৃষির স্বার্থের, নিজ দেশের কৃষকের ভাগ্যকে বিসর্জনের নাটক সাজিয়ে। কৃষি ক্ষেত্রে এই সব কারসাজির সাথে মানবপাচার উৎসাহিত হওয়ার প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে।
ভারতীয় চাল এ বছরের বাড়তি উপকরণ। কিন্তু প্রতিবছরই ধান ওঠার সময়ে সরকার কৃষকের শ্রমের দাম না ধরেই ধানের দাম নির্ধারণ করে এবং তাও আবার কেনা হয় চাতালমালিক আর দলীয় লোকদের কাছ থেকে। এরই ফল গ্রামীণ জীবনে অস্থিরতা। এভাবে গ্রামত্যাগে বাধ্য হওয়া নারীদের একটা বড় অংশ পোশাকশিল্পে কাজ নিতে বাধ্য হন। পুরুষদেরও একটা অংশ রিকশা চালানো, হকারিসহ নানা পেশায় যুক্ত হন। এভাবে নিজ দেশে অতি উৎপাদনের কালেও উদ্বৃত্তে পরিণত হওয়া মানুষের একটা অংশ অজানায় ঝাঁপ দেওয়ার ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত থাকেন। এদের কাহিনীই আমরা পড়ছি দৈনিকের পাতায় পাতায়, দেখছি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদে।
৮.
বহু দরিদ্র অর্থনীতিতেই রূপান্তরের কালে একটা স্বল্প মেয়াদে অভিবাসী হওয়ার তীব্র প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশে এটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি আকারে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে স্বাধীনতার পর প্রতিটা বছরেই। প্রতি দশকে বাজেটের আকার বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে। কিন্তু অভিবাসী হওয়ার আকুলতা বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতির মৌলিক গঠন কাঠামোরই একটা ভয়ঙ্কর সমস্যার দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয় দিচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে আজ সচ্ছল পরিবারগুলো বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর পাশাপাশি বহুগুণ বেশি পরিবারে পাওয়া যাবে বিদেশে যেয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার, জীবনের মূলবান সময়ের অপচয় শেষে ফেরত আসার ছাপা-না-হওয়া গল্প। পাওয়া যাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার অজস্র কাহিনী। প্রতিটা দশকেই আরো খারাপ থেকে খারাপতর শ্রম পরিবেশেও কাজ করতে রাজি হওয়া মানুষদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি ‘মানবপাচার, অভিবাসী শ্রমিক এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক গণসংহতি আন্দোলনের মতবিনিময়ে পরিস্থিতির সারসংকলন করা হয়েছে এভাবে : বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। অন্যদিকে এক গত ১০ বছরে দেশে এসেছে প্রায় ২০ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। এই লাশগুলোর দায় কেউ নেয়নি। এই মৃত্যুগুলোর একটা বড় অংশই অস্বাভাবিক। কর্মস্থলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে অসুস্থতা, বাসস্থান ও খাদ্য সংকট, কর্মস্থলে শারীরিক নিপীড়ন, স্থানীয় বাসিন্দাদের হামলা, গ্রেফতারের আতঙ্ক, উদ্বেগ এই সব কিছুই এই মৃত্যুর সারিকে দীর্ঘতর করেছে। গোপনে পাচারের সময়ে কত অজস্র বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন মালবাহী ট্রাকে বা জাহাজের খোলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, জাহাজডুবিতে, সীমান্তরক্ষীর তাড়া খেয়ে বরফে জমে তার ইয়ত্তা নেই। এই মৃত্যুর হার কত উদ্বেগজনক হারে প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বোঝা যাবে একটি সরকারি তথ্য থেকেই। ২০০৮ থেকে ২০১৩-ছয় বছরে ৫৬টি দেশ থেকে লাশ এসেছে ১৩ হাজার ৮৭২ জন প্রবাসীর। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসেছে ছয় হাজার ১৭টি লাশ। আরো আগে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিন হাজার ৬১৩ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ আসার তথ্য আছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।
বোঝাই যাচ্ছে, পরিস্থিতিটা কোনো সাময়িক বিষয় না। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ কোনো নির্ভরশীলতার যায়গায় পৌঁছাতে পারেনি গত দশকগুলোতে, নাগরিকদের কর্মসংস্থান বা উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ যেটুকু বিকশিত হয়েছে তা পরিস্থিতির তুলনায় এত সামান্য যে, হাঁস পেলে কি ছাগল চাষে সাফল্য পাওয়া গেলে আজও তা পত্রিকার শিরোনাম হয়। যে অজস্র মানুষ মুরগির খামার করে আটকা পড়েছেন, স্ট্রবেরি কি নতুন কোনো শস্য চাষ করতে যেয়ে দাম না পেয়ে বিপন্ন হয়েছেন, তারা ঠাঁই পাচ্ছেন না পত্রিকার পাতায়। যে দুটি খাতে মুনাফার ভাগ জনগণের পকেটে গেলে জনগণে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত, দেশে শিল্পভিত্তি বিকশিত হতো, তার একটা পোশাকশিল্প, অন্যটি কৃষি। কৃষিতে কৃষকের মুনাফা কমিয়ে রাখা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে সস্তায় পোশাকশ্রমিক পাওয়া যায়। ফলে এই বিপুল উৎপাদনের কালেও কেন্দ্রাতিগ একটা বল অজস্র মানুষকে ছিটকে দিচ্ছে তার মাতৃভূমি থেকে।
ফলে অবৈধ অভিবাসনের আশু সমাধান একটাই, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাজার সন্ধান, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানবিক আইনি নিশ্চয়তাপূর্ণ বাজারে তাদের প্রেরণ। অন্যদিকে প্রয়োজন কৃষিপণ্যের মুনাফাটা যেন কৃষকের হাতে যায়, দলীয় লোকজন আর চাতালমালিকরা, সার-কীটনাশক আর বীজ ব্যবসায়ীরা যেন কৃষির সর পুরোটা খেয়ে না ফেলে। তাহলে অভিবাসনের চাহিদা যেমন কমবে, কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশের মাঝে শিল্পোদ্যোগ আর কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু আশু কিংবা দূরবর্তী সব কিছু বাদ থাক। এই মুহূর্তে এই মানবিক সংকট আকারে বর্তমান সমস্যাটা মোকাবিলায় সরকার কী ভূমিকা রাখছে? সাগরে ভাসছে তার হাজার আটেক পরিত্যক্ত নাগরিক। মাঝি-মাল্লা-দালালরা পালিয়েছে যন্ত্রচালিত নৌযানে। তাদের নেই খাবার-পানি-ওষুধ। এই শ্রমিকদের শ্রমে যারা ভোজ্যতেল বা মৎস্যশিল্প গড়ে তুলেছে, তারাই সবচেয়ে অমানবিক কায়দায় তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে সাগরে। যত অবৈধ হোক, দুনিয়ার যে আইন সে ভেঙে থাকুক, কেন তাদেরকে উদ্ধার করার দায় আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার ঘোষণা করেনি একদম প্রথম দিন? কেন সরকার বলছে না অবিলম্বে নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়ে, জাহাজ ভাড়া করে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে এদেরকে সে ন্যূনতম সময়ে ফেরত আনবে? কেন তারা মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডকে অনুরোধ করছে না অন্তত দিন পনেরো তাদের তীরে আশ্রয় দিয়ে খাবার-পানি-ওষুধ-শুশ্রুষা দেওয়ার জন্য?
ফিরোজ আহমেদ : কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন।