বাংলাদেশে পাবলিক টয়লেটের সংকট
১৯৭৫ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন তাহমিমা আনাম। তিনি বড় হয়েছেন প্যারিস, নিউইয়র্ক ও ব্যাংককে। লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট হলোকে কলেজ (Mount Holyoke College) ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ২০০৫ সালে হার্ভার্ড থেকে সামাজিক নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অ্যা গোল্ডেন এজ’। এই বইয়ের জন্য ‘সেরা প্রথম উপন্যাস’ ক্যাটাগরিতে কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ জিতেছেন তিনি। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য গুড মুসলিম’। এই ট্রিলোজি উপন্যাসের শেষ অংশের কাজ করছেন তিনি এখন।
লন্ডনে বসবাসরত তাহমিমা নিয়মিত লিখছেন ‘দ্য নিউ স্টেটসম্যান’, ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এবং ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মতো প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে। তাহমিমা আনামের এই লেখা গত ২১ মে ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মতামত পাতায় ছাপা হয়েছে। সেখান থেকে লেখাটি ভাষান্তর করেছেন ফাহিম ইবনে সারওয়ার।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা টানা অস্বস্তিকর জ্যামে বসে থাকতে থাকতে অনেক কিছু সহ্য করা শিখে গেছেন। কেউ জ্যামে বসে ঘুমিয়ে নেন, কেউ বা নিজের কাজ সেরে নেন ফোনে, কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সময় কাটান।
আমার মা আমাকে প্রায়ই ঢাকার জ্যামে বসে বিরক্ত হয়ে টেক্সট পাঠান, ‘এখনো মহাখালীতেই আটকে আছি’। ‘বনানী থেকে গুলশান থেকে দুই ঘণ্টা’।
ঢাকার এত এত যাত্রী সবার পথ আলাদা কিন্তু বাসে ওঠার আগে সবাই প্রাকৃতিক কর্মটি সেরে নেন মনে করে। কারণ একবার ঢাকার বাসে উঠে পড়লে আপনি আর আশপাশে কোথাও সে সুযোগ পাবেন না।
আমি যদি পারতাম তাহলে একটা বই লিখতাম, ‘বাংলাদেশে কোথায় কোথায় প্রস্রাব করবেন’। এটা খুবই ছোট একটা বই হতো কিন্তু খুবই কাজের, সব সময় সাথে রাখার মতো। এটা পড়ে আপনি জানতে পারতেন যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় দেড় কোটি মানুষের জন্য মাত্র ৬৭টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। এবং এই ৬৭টি দুর্লভ পাবলিক টয়লেটের পানি ও বিদ্যুৎ ঠিকমতো থাকে না। ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র পাঁচটি পাবলিক টয়লেট ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার উপযোগী।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০০৫ সালের স্যানিটেশন কর্মসূচির আওতায় নতুন নতুন পাবলিক টয়লেট নির্মাণে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট কন্ট্রাক্টরদের সে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ নতুন পাবলিক টয়লেট করার মতো ক্ষমতা বা জনবল সিটি করপোরেশনের নেই। কিন্তু এই পদ্ধতি কাজে লাগেনি। কারণ প্রাইভেট কন্ট্রাক্টররা জায়গাগুলো নিয়ে পাবলিক টয়লেটের বদলে সেখানে পানি বিক্রি করেন বা গাড়ি ধোয়ার কাজে ব্যবহার করেন। এমনকি মাঝে মাঝে সেখানে ভাড়ায় নিম্ন আয়ের লোকজনকে রাতে ঘুমাতে দেওয়া হয়।
ঢাকায় পাবলিক টয়লেটের এই সংকটে নারী-পুরুষ সবাই ভুক্তভোগী। পুরুষদের খোলা রাস্তায় সে কর্ম সম্পাদনের সুবিধা রয়েছে। ফুটপাত, গলির রাস্তায় বা রেলের পাশে প্রায়ই পুরুষদের মূত্রত্যাগের ব্যাপারটা খুব চেনা দৃশ্য। বৃষ্টির দিনে ড্রেনের পাশে সারি সারি ছাতা দেখবেন যার নিচে বসে পুরুষরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। ঢাকায় রাস্তার আশপাশের প্রায় সব দেয়ালেই প্রস্রাবের কাজটি করার স্বাধীনতা পুরুষদের রয়েছে।
তাই দেয়ালগুলোতে বাংলায় লেখা থাকে, ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে সেদিকে নজর দেওয়ার ফুরসত কারো থাকে না। এমনকি যত্রতত্র মূত্রত্যাগের জন্য জরিমানার বিধান থাকলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না।
নৃতাত্ত্বিক ম্যারি ডগলাস মাটিকে ময়লা বা ডার্টকে ‘বাইরের বস্তু’ বা ‘matter out of place’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা কোনো জায়গাকে কীভাবে নোংরা করব সেটা পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি পাল্টাতে চায়। তারা পরিবেশ নোংরা করার এই অভ্যাসকে পরিবর্তন করতে চাইছে।
যেসব দেয়ালের আশপাশে হরহামেশাই মূত্র ত্যাগ করা হয়, সেসব দেয়ালে চুনকাম করে আরবি হরফ লিখে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। উদ্দেশ্য মানুষকে মূত্রত্যাগ থেকে বিরত রাখা এবং সঠিক রাস্তা প্রদর্শন করা। আরবি হরফ ব্যবহারের যুক্তি ছিল, মানুষ এটাকে পবিত্র মনে করে ওই দেয়াল নষ্ট করবে না।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে একটি ভিডিও তৈরি করেছে যার শিরোনাম, ‘ভাষা গুরুত্বপূর্ণ’ (Language Matters)। ভিডিওটিতে দেখা গেছে কিছু মানুষ বাংলা লেখা মুছে সেখানে আরবিতে লিখে দিচ্ছে, ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই আরবি লেখা পড়তে পারেন না। ভিডিওটিতে ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস ওভারে একজন বলছেন, ‘আরবি মানুষের কাছে পবিত্র ভাষা হিসেবে পরিচিত।’
ভিডিওটিতে দেখা গেছে, সাদা দেয়ালের দিকে প্রস্রাব করার জন্য পুরুষরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দেয়ালে আরবি লেখা দেখে দেয়ালে সালাম করে সেখান থেকে সরে যাচ্ছেন। আরবি লেখার নিচে প্রস্রাব করতে যাওয়ার জন্য অপরাধবোধে ভুগছিলেন তাঁরা। তাঁদের কর্মকাণ্ড বা চেহারা থেকে তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
দেয়াল লিখনে আরবির নিচে বাংলায় লেখা ছিল নিকটস্থ মসজিদে যাওয়ার নির্দেশনা। আমার মনে হয় এই প্রচারণার মাধ্যমে ধর্ম মন্ত্রণালয় এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে। প্রথমত, রাস্তাঘাটে পুরুষদের প্রস্রাব করা বন্ধ করা এবং দ্বিতীয়ত তাঁদের আরো বেশি মসজিদমুখী করা।
আমার মনে হয় এটা মানুষকে ঠেলা দিয়ে সামনে দিকে নিয়ে যাওয়া বা সরিয়ে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ভুল। কারণ বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই ভাষা, জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, উর্দু হবে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, বাংলা নয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধেও ভাষা এবং বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই মানুষ যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি সেনারা সে সময় রাস্তায় থামিয়ে মানুষদের জিজ্ঞেস করত, তারা কি মুসলিম নাকি বাঙালি? ভাবটা এমন যেন বাঙালি হলে মুসলিম হওয়া যায় না।
তাই এই দেয়াল লিখন সেই পুরোনো দ্বন্দ্বেরই একটি ছায়া হয়ে বর্তমানে ফিরে এসেছে। আপনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশিরা নিজেদের বাংলা ভাষার ওপর প্রস্রাব করছে কিন্তু বাইরের আরবি ভাষাকে সম্মান করে সরে যাচ্ছে।
এ নিয়ে বাংলাদেশে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এই প্রচারণার পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে পাবলিক টয়লেটগুলোর উন্নয়নে কাজ করা যেত। কারণ সারা ঢাকা শহরের সব দেয়ালে আরবি লেখা হলেও মানুষের প্রস্রাব করার জায়গা তো বাড়ছে না।
বলা হয়, ঢাকার জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকায় দুই কোটি মানুষ বাস করবে। সরকারের দায়িত্ব ঢাকায় বসবাসরত সবার নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা। ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, মুদি দোকানি, ট্রাকড্রাইভার সবারই এসব সুবিধা ঠিকঠাকভাবে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মৌলিক চাহিদা এবং সম্মান তাদের প্রাপ্য। গবেষকরা বলছেন, ঢাকায় প্রায় ৫০ লাখের মত গরিব শ্রমিক দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টার মতো বাইরে খোলা রাস্তার নিচে কাজ করে।
যদি ঢাকা সিটি করপোরেশন আরো পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে তবুও বাংলাদেশের স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান হবে না। পুরুষরা যেখানে স্বাধীনভাবে জনসম্মুখে ব্যস্ত রাস্তায় দেয়ালের পাশে মূত্রত্যাগ করছে সেখানে আমরা নারীদের স্বাধীনতা তো দূরে থাক, রাস্তায় বেরোলে তাদের চলাফেরার নিরাপত্তাটুকু দিতে পারছি না।
দেয়ালে দেয়ালে আরবি লেখার যে প্রচারণা ধর্ম মন্ত্রণালয় চালিয়েছে, তাতে শুধুমাত্র পুরুষদের অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন রাস্তায় প্রস্রাব না করে সেটা অন্য কোথাও গিয়ে করে। কিন্তু নারীদের একই সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, উল্টো সেটাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে খুব স্পষ্ট করেই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে যে পাবলিক প্লেসগুলোতে পুরুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, তার তুলনায় নারী তাঁর মৌলিক নিরাপত্তার অধিকার থেকেই বঞ্চিত। নারীদের ব্যাপারটা মন্ত্রী নিজেই উপেক্ষা করে গেছেন। কারণ তিনি পুরুষদের কাছাকাছি মসজিদে যাওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু নারীরা যেমন রাস্তায় মূত্র ত্যাগ করতে পারেন না, তেমনি বেশির ভাগ মসজিদেই নারীদের যাওয়ার বা নামাজ পড়ার সুযোগ নেই।
রাস্তায় পুরুষদের মূত্রত্যাগের মতো অস্বাস্থ্যকর বিষয় বন্ধ করার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এই প্রচারণার সাথে নারীদের জন্য অপর্যাপ্ত শৌচাগারের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা দরকার ছিল। না হলে এটাই বোঝা যায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা বলতে চাইছি, আমাদের রাস্তাগুলো শুধুমাত্র পুরুষদের ব্যবহারের জন্য আর দেয়ালগুলো আরবি লেখার জন্য বরাদ্দ।