মালয়েশিয়ায় পড়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ, হাজারো শিক্ষার্থীর কান্না
মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার কথা বলে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন কলেজে ভর্তি করানোর নামে এই শিক্ষার্থীরদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
অখ্যাত কিছু বেসরকারি কলেজের দালালদের মাধ্যমে এসব প্রতারণা করা হচ্ছে। প্রতারণার খপ্পরে পড়া শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন সমস্যার।
এসব সমস্যায় যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর বুঝতে পারেন তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। পাচার বাণিজ্যের শিকার তাঁরা।
আর তখন পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে মানবেতর পরিবেশে অবৈধভাবে কাজ করতে হয় সেই শিক্ষার্থীদের। অসহায় আর্তনাদ আর কান্না ছাড়া তাঁদের করার কিছুই থাকে না।
পরিবারের অনেক টাকা ব্যয় করে মালয়েশিয়ায় পড়তে যাওয়া হাজার হাজার বাংলাদেশি আটকা পড়েন চাঁদাবাজির জালে। গত সোমবার মালয়েশীয় সংবাদমাধ্যম দ্য স্টার-এ প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে এই ভয়াবহ তথ্য।
দ্য স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, অখ্যাত কিছু বেসরকারি কলেজ তাদের দালালদের মাধ্যমে কয়েক হাজার বাংলাদেশি তরুণ মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। মালয়েশিয়ার এসব কলেজে ভর্তি হতে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য এই দালালদের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ২০ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন লাখ ৭৭ হাজার টাকা) পর্যন্ত নেন।
দ্য স্টারের সংবাদে আরো বলা হয়, পাচার-বাণিজ্যের শিকার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর বুঝতে পারেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আশায় তারা যে কলেজে ভর্তি হয়েছেন সেখানে আসলে ক্লাস হয় না। আবার স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কারণে তাঁরা সেখানে বৈধভাবে কাজও করতে পারেন না এবং তাঁদের অনেক সময় অতিরিক্ত ফি দিতে হয়।
অনেকেই তখন অন্য উপায় না পেয়ে মানবেতর পরিবেশের মধ্যে অবৈধভাবেই কাজ করেন। পাওনা টাকা মেটানো, বাড়ি ফেরার টিকেট কেনা এবং স্টুডেন্ট ভিসা নবায়নের জন্য (এই ভিসা নবায়ন করলে আরো এক বছর তারা কাজ করতে পারেন) এবং দালালদের টাকা দেওয়ার চিন্তায় তাঁরা লেখাপড়ার কথা ভুলে গিয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করেন।
দ্য স্টার জানায়, দেশটির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘আরএজ’ নামের একটি সংগঠন দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ পাচারচক্রগুলোকে উন্মোচন করেছে। সংগঠনটির নতুন একটি ভিডিও সিরিজে সবকিছু তুলে ধরা হয়েছে। দ্য স্টার জানায়, আরএজ-এর ওই দলটির সদস্যরা ফ্যাক্টরি ম্যানেজার সেজে সস্তায় শ্রমিক খুঁজছিলেন। তখনই দালালদের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়।
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থী পাচার-বাণিজ্য প্রক্রিয়াটি এ সময় তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
দালালদের একজন তখন জানান, তিনি দাতুক নামের এক ব্যক্তির হয়ে কাজ করেন। কুয়ালালামপুরে দাতুকের একটি কলেজ রয়েছে এবং তিনি মালয়েশিয়ায় আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে এনেছেন (পাচার করেছেন) বলেও স্বীকার করেন ওই দালাল।
দালালদের মধ্যে মালয়েশীয় ছাড়াও অন্য দেশের নাগরিকও রয়েছেন। আর কথা বলা এই দালালটি ছিলেন নেপালের নাগরিক।
দ্য স্টারের সাংবাদিককে নেপালি দালাল বলেন, ‘বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদেরকে জোগাড় করা সহজ এবং দ্রুত টাকা পাওয়া যায়। ২০০-৩০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে এখানে নিয়ে আসো এবং বিভিন্ন কলেজে ভাগ করে দাও আর তুমি টাকা কামাও।’
অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আরএজ দল ৩০ জনেরও বেশি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর দেখা পেয়েছে। তা ছাড়া শিক্ষার্থী পাচারকারীদের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন ৩০টি কলেজকেও শনাক্ত করেছে তারা।
ভুক্তভোগী এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী দ্য স্টারকে জানান, তাঁর বাবা দুইবার স্ট্রোক করেছেন। বাবার ওষুধ খরচের টাকা জোগাড়ের জন্য তাঁর অবৈধভাবে কাজ না করে উপায় নেই।
ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি বাড়ি যেতে পারছি না, কারণ আমার পরিবার দালালদের হাতে তাদের সব সঞ্চয় দিয়ে দিয়েছে।’
আরেক শিক্ষার্থী জানান, তাঁকে মালয়েশিয়ায় পড়াতে পরিবার ঋণ নিয়েছে। মাসে মাসে তাদেরকে ২১ হাজার টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এখন সেখানে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছেন ওই শিক্ষার্থী। তাঁর মাসিক আয় ২৮ হাজার টাকা। এই অর্থ থেকেই দেশে টাকা পাঠাতে হয় তাঁকে।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঢাকায় যেভাবে আস্তাকুঁড়ে ময়লা ফেলা হয় তার চেয়েও বাজেভাবে এখানে জীবন-যাপন করছি আমরা।’
দ্য স্টার জানায়, তাদের এক সাংবাদিক ওই কলেজগুলোর একটিতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী হিসেবে যান। কিন্তু তাঁদে নিষেধ করে দেওয়া হয়। কলেজের এক কর্মী বলেন, ‘আমাদের নিজেদের লোক (মালয়েশীয়) এখানে ভর্তি হতে চাইলে আমরা নিষেধ করি। চারদিকে দেখুন। পুরো স্থান ফাঁকা। আমি চাই না কোনো শিক্ষার্থী এখানে আটকা পড়ুক।’
এর আগে ২০১৩ সালে অখ্যাত কলেজের মাধ্যমে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পাচারের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল দ্য স্টার। ২০১৫ সালে এ ধরনের চারটি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী লাইসেন্স বাতিল করেছিল মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রণালয়।