মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন সরাইলের ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরিফাইল গ্রামে অবস্থিত প্রায় চারশো বছর পুরোনো ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’ ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।
মুঘল স্থাপত্যের সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই ঐতিহাসিক মসজিদটি বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব ও নান্দনিক নির্মাণ শৈলীর কারণে এটি দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্বরোড অংশের নিকটে সরাইল উপজেলা চত্বর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই মসজিদটি ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। এর সুদৃশ্য গম্বুজ, সুসজ্জিত মিহরাব, সুশোভিত মিনার ও দেয়ালের খোদাইকৃত কারুকাজ মুগ্ধ করার মতো। মসজিদের ভেতরের অংশে রয়েছে সুন্দর ক্যালিগ্রাফি, যাতে পবিত্র কুরআনের আয়াত অঙ্কিত রয়েছে। প্রাচীন বাংলার মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া স্পষ্টভাবে মসজিদটির গঠন শৈলীতে প্রতিফলিত হয়েছে।
মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে এক বিশাল দিঘি, যা স্থানীয়দের কাছে ‘সাগরদিঘি’ নামে পরিচিত। যা মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই দিঘীর পানি পান করলে রোগ মুক্তি লাভ করা যেত।
মসজিদের দক্ষিণে রয়েছে দুটি ঐতিহাসিক কবর, যা ‘জোড়াকবর’ বা ‘রহস্যময়কবর’ নামে পরিচিত। কবর দু’টিতে ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর ছাপ স্পষ্ট। এগুলো ঘিরে নানা কল্প কথা প্রচলিত রয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, মাজার হিসেবে পরিচিত এই কবরের সামনে মান্নত করলে তা পূর্ণ হয়, ফলে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী এখানে আসেন।
৮০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের এই মসজিদের চার কোণে চারটি বুরুজ এবং তিনটি গম্বুজ রয়েছে। ভেতরে প্রতিটি গম্বুজের নিচের অংশ মসজিদটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছে। গম্বুজগুলোর গায়ে খোদাই করা পদ্মফুলের নকশা মুঘল স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে।

ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এক সময় সরাইল ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী এবং এটি বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর শাসনাধীন ছিল। ধারণা করা হয়, ঈশা খাঁ এই মসজিদ ও এর পার্শ্ববর্তী ‘জোড়াকবর’ নির্মাণ করেন। অনেকে মনে করেন, ঈশা খাঁর দুই স্ত্রীর কবর এখানে স্থাপন করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের স্মরণে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। কবর দুটি পাশাপাশি থাকার কারণে এটি ‘জোড়াকবর’ নামে পরিচিতি পায়। একটি রহস্যজনক তথ্য হলো, কবর দুটির নিচে একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে, যার শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। জনশ্রুতি অনুসারে, ভীতি ও কুসংস্কারের কারণে কেউই এই সুড়ঙ্গের শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধান করতে সাহস করেনি, ফলে এটি আজও রহস্যাবৃত।
অন্যদিকে, অনেকের মতে, দরবেশ শাহ আরিফ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এবং তার নামানুসারেই মসজিদের নামকরণ করা হয়। তবে ‘জোড়াকবর’ সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্য এখনো অনাবিষ্কৃত। মসজিদের দেয়াল অত্যন্ত পুরু হওয়ায় ভেতরে যে কোনো শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে এক ভিন্ন অনুভূতি সৃষ্টি করে। অনেকের কাছে এটি রহস্যময় মনে হয় এবং কেউ কেউ একে অলৌকিক আলামত হিসেবে বিবেচনা করেন। প্রতিদিন এখানে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। বিশেষ করে জুমার দিনে মুসল্লিদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব, স্থাপত্যশৈলী এবং রহস্যময় তা মিলিয়ে ‘আরিফাইল শাহী জামে মসজিদ’ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও পর্যটকদের জন্য এক দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে মসজিদটি সংরক্ষণ করা হলে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে।