ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যের প্রথম নেতা

‘শ্বেতাঙ্গ ক্যারিবীয় অধিনায়ক’- না, ঠিক মনে পড়ছে না। ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, ড্যারেন স্যামি সবাইতো কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু ইতিহাস বলে, একসময় শ্বেতাঙ্গ অধিনায়কত্বেই পরিচালিত হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। আর এর পরিবর্তন আসে ১৯৬০ সালে। ক্যারিবীয় ক্রিকেটে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হিসেবে নাম লেখান স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল। আর তাঁর অধিনায়কত্বের মধ্য দিয়েই ক্যারিবীয় ক্রিকেট থেকে বিদায় নেয় শেতাঙ্গ অধিনায়কত্ব। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিশ্বস্ত হাতেই ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যের শুরু। আজকের দিনেই বিশ্ব ক্রিকেটে টেস্ট অভিষেক হয় এই ঐতিহাসিক অধিনায়কের। যিনি অভিষেক টেস্টেই জানিয়ে দেন তাঁর আগমন বার্তা।
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল। ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে মুখোমুখি ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামে ইংলিশরা। পাঁচ রানেই জ্যাট রবার্টসন বিদায় নিলেও বিলি গ্রিফিথের ১৪০ ও জিম লেকারের ৫৫ রানের ওপর ভর করে ৩৬২ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। উইল ফার্গুসন ১৩৭ রানে তুলে নেন পাঁচ উইকেট। ব্যাট হাতে জবাব দিতে নেমে ক্যারিবীয় শিবিরে দুর্দান্ত সূচনা এনে দিলেন ওপেনার জর্জ ক্রো এবং অ্যান্টি গ্যান্টেয়াম। দলীয় ১৭৩ রানে ক্রো বিদায় নিলে মাঠে নামেন এভারটন উইকস (স্যার এভারটন উইকস)। ২২৬ রানে উইসের বিদায়ের পর মাঠে নামেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। অপরপ্রান্তে সেঞ্চুরিয়ান অ্যান্টি গ্যান্টিয়াম ও এরপর ক্লাইড ওয়ালকট (স্যার ক্লাইড ওয়ালকট) ফিরলেও উইকেচে জেকে বসেন ওরেল। ৯৭ রানে আউট হলেও এই ইনিংসটাই তাকে পরবর্তী সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলনেতা হতে সাহায্য করেছে। ওরেলের অভিষেক ইনিংসই স্বপ্ন দেখাচ্ছিল অদূর ভবিষ্যতের। অবশেষে ৪৯৭ রানে থামে ক্যরিবীয় ইনিংস।
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে জ্যাট রবার্টসনের ১৩৩ রানের ওপর ভর করে সংগ্রহ করে ২৭৫ রান। উইল ফার্গুসন এবার ৯২ রানে তুলে নেন ৬ উইকেট। ১৪১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ২৩ ওভারে ৩ উইকেটে ৭২ রানে শেষ হয় শেষ দিনের খেলা। ফ্রাঙ্ক ওরেল ২৮ ও জর্জ ক্রো ১৮ রানে অপরাজিত থেকে ড্র করেন ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট। তবে সব কিছু ছাপিয়ে মূল আলোচনায় ছিলেন অভিষিক্ত ফ্রাঙ্ক ওরেল।
স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল তাঁর সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ৫১টি। গড় ৪৯.৪৮ করে মোট রান করেছেন ৩ হাজার ৮৬০। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ২৬১ রানের পাশাপাশি আছে ৯টি সেঞ্চুরি ও ২২টি হাফ সেঞ্চরি। আর বাঁ হাতের মিডিয়াম ফাস্ট বোলিংয়ে তাঁর ঝুলিতে আছে ৬৯টি উইকেট। সেরা বোলিং ফিগার ৭/৭০। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ২০৮টি ম্যাচ খেলে ৫৪.২৪ গড়ে রান করেছেন ১৫ হাজার ২৫। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩০৮ রানের পাশাপাশি আছে ৩৯ সেঞ্চুরি ও ৮০টি হাফ সেঞ্চুরি।
১৯৬০-৬৩ সাল পর্যন্ত ওযেস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার অধিনায়ত্বেই ক্রিকেটে বিশ্বে আধিপত্য শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এভারটন ডি. উইকস এবং ক্লাইড ডি. ওয়ালকটকে নিয়ে গড়ে তোলেন বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউ’ জুটি। বহু ম্যাচে ক্যারিবীয়দের জয় এনে দিয়েছে এই জুটি। ১৫ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ৯টিতেই দলকে জেতান তিনি।
ক্রিকেটের বাইরে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। ১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সতীর্থ পেসার চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সারে আঘাত পান সফরকারী ভারতীয় ক্রিকেটদলের অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর। এ সময় তিনিই রক্ত দান করে বাঁচিয়ে তোলেন নরি কন্ট্রাক্টরকে। সেই থেকে প্রতিবছর ৩ ফেব্রুয়ারি ফ্রাঙ্ক ওয়েলের স্মরণে ‘ফ্রাঙ্ক ওরেল ডে’ তে রক্তদান কর্মসূচি পালন করে ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীরা। এর আগে ১৯৬০ সালে তাঁর নামানুসারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সিরিজের নাম রাখা হয় ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি। মজার বিষয় হলো, নিজের নামানুসারে রাখা প্রথম সিরিজে খেলেন তিনি!
১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে দলের সঙ্গে ভারত সফরে যান ওরেল। সেখানে থাকাকালীন তাঁর শরীরে ধরা পড়ে লিউকিমিয়ার অস্তিত্ব। অবশেষে ১৯৬৭ সালের ১৩ মার্চ বিশ্বকে বিদায় জানান ক্রিকেট বিশ্বের ঐতিহাসিক অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক মর্টিমার ম্যাগলিন ওরেল।