বাফুফেতে সালাউদ্দিন যুগ : আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি
সময়টা ২০০৩, বাফুফের সহ-সভাপতি হয়ে সংগঠক রূপে আবির্ভাব কিংবদন্তি ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিনের। এর ঠিক দুই বছরের মাথায় সভাপতি পদে নির্বাচনের ঘোষণা দেন তিনি এবং জিতেও যান। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো বাফুফের দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর আরও তিন মেয়াদে ছিলেন দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নেতৃত্বে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল সালাউদ্দিনের আমলে দেশের ফুটবল।
বাফুফের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৬ অক্টোবর। সভাপতি পদে টানা পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন করার কথা থাকলেও হুট করেই সরে দাঁড়িয়েছেন সালাউদ্দিন। স্বাভাবিকভাবেই তার এমন ঘোষণা চমকজাগানিয়া। সালাউদ্দিনের আমলে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী।
ব্যর্থতার শুরুটা হয় ২০১১ সালে মেসির আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার মধ্যে প্রীতি ম্যাচ আয়োজনের মাধ্যমে। সবাইকে চমকে দিয়ে ঢাকায় মেসিদের আনেন সালাউদ্দিন। তবে, সেই আয়োজনে কোটি কোটি টাকার ঋণ এখনও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বাফুফেকে। এখানেই শেষ নয়, প্রথমবারের মতো সিলেট বিকেএসপিতে বাফুফের একাডেমি করা হয়েছিল। সে সময় ফিফা থেকে মোটা অঙ্কের অনুদান পেয়েও দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে সেই একাডেমি। কোথায়, কীভাবে খরচ করা হয়েছে সেই অর্থ, তার হিসেব আজও মেলেনি। এমন ঘটনায় বাংলাদেশে আর কোনো একাডেমিতে বিনিয়োগ করেনি ফিফা। যা বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।
সালাউদ্দিনের আমলে দেশের ফুটবল খুব বেশি এগোয়নি। বিশেষ করে ছেলেদের ফুটবলে বেহাল দশা ফুটে ওঠে। একটা সময় নেপাল-ভূটানকে অনায়াসে হারানো দলটিই কিনা, রীতিমত মুখ থুবড়ে পড়ছে। বয়সভিত্তিক দলগুলোতে সাফল্য পেলেও দীর্ঘমেয়াদে ফুটবলের উন্নয়নে তেমন কিছুই করেননি তিনি।
২০০৮ সালে প্রথম দফায় সালাউদ্দিন যখন সভাপতির চেয়ারে বসেন তখন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৮০ নম্বরে। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৪তে। বিস্ময় জাগানিয়া তথ্য হলো ২০১৭ সালে র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৭তে নেমে গিয়েছিল লাল-সবুজের দল। গত ১৬ বছরে কখনও র্যাঙ্কিংয়ে তেমন উন্নতিই করতে পারেনি বাংলাদেশ। তার আমলে আটবার সাফ খেললেও সেমিফাইনালে গিয়ে দুইবার আটকে গেছে বাংলাদেশ। পাঁচবার তো বিদায় নিয়েছে গ্রুপপর্ব থেকেই।
সালাউদ্দিন যুগে পুরুষ ফুটবলে ব্যর্থতায় পরিপূর্ণ হলেও নারী ফুটবলে বেশ কিছু সাফল্যের দেখা মিলেছে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। খেলেছে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টেও সাফল্য আছে। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য নিশ্চিতভাবেই মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়। ২০২২ সালে নেপালের আসরে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল সাবিনা খাতুনরা।
তার আমলে আরেকটি বড় সমস্যা ছিল কোচ পরিবর্তন। দেশি কোচদের সুযোগ না দিয়ে মোটা বেতনে বিদেশি কোচদের দায়িত্ব দেওয়া হতো। জাতীয় দলের কোচ পরিবর্তন রীতিমত নেশায় পরিণত হয় বাফুফের। গত ১৬ বছরে যে কতজন কোচ পরিবর্তন করেছে বাফুফে, সেই হিসেব করাটাও কঠিন। কোচ বদলালেও তেমন কোনো সাফল্যের দেখা পায়নি বাংলাদেশ।
এই সময়কালে সবচেয়ে বেশি আলোচনার ঘটনার জন্ম দিয়েছে বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের আর্থিক অনিয়ম। যে অভিযোগের ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য ফিফা থেকে নিষিদ্ধ করা হয় তাকে। এছাড়াও বাফুফে থেকে সোহাগকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয়।
এছাড়াও বাফুফের ফিন্যান্স কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ফিফা ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এমন ঘটনা দেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম। শুধু তাই নয় সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করেও বেশ সমালোচনায় পড়েছিলেন সালাউদ্দিন। অবশ্য সমালোচনা কখনও গায়ে মাখেননি এই সাবেক ফুটবলার।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সালাউদ্দিন যুগের অবসান। আগামী ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে বাফুফে নির্বাচন। নতুন নেতৃত্বে বদলে যেতে পারে দেশের ফুটবল। পৌঁছাতে পারে সাফল্যের শিখরে। অন্ধকার মাড়িয়ে সুদিন ফিরতে পারে দেশের ফুটবলে, এমনটাই প্রত্যাশা সমর্থকদের।