জুলাই অভ্যুত্থানের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া বিপিএল
‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা’—বাংলা এই প্রবাদটির সঙ্গে বড্ড মিল রয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের। প্রতি আসরেই বিপিএলের সার্বিক মান ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে খোদ ক্রিকেটাররাও। প্রশ্নবাণে জর্জরিত বিসিবি নানা সময়ে আশার বুলি শোনালেও বদলায়নি দৃশ্যপট। দেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই আসরকে নিয়ে ফুরাচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ।
আইপিএল, পিএসএলের মতো টুর্নামেন্টগুলো যেখানে নিত্যনতুন কর্মকাণ্ডে সবাইকে চমক দিচ্ছে, সেখানে গত ১০ আসরে বিসিবি শুধু হতাশই করেছে। না ভক্ত সমর্থকদের প্রত্যাশা, না ক্রিকেটারদের মান উন্নায়ন; বিপিএলে প্রাপ্তি খোঁজাই যেন বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সব হতাশাকে পেছনে ফেলে নতুন সাজে আসছে এবারের বিপিএল।
বিপিএলে জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের স্পৃহা কাজে লাগাতে শুরু হচ্ছে তারুণ্যের উৎসব-২০২৫। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিনে উন্মোচন করা হয় বিপিএলের প্রথম মাসকট। যা এর আগে অনুষ্ঠিত ১০ আসরে দেখা যায়নি। সবমিলিয়ে খেলা মাঠে গড়ানোর আগেই নতুনত্বের দিক দিয়ে আগের সব আসরকে ছাপিয়ে গেছে বিপিএল।
মূলত জুলাই অভ্যুত্থানের ছোঁয়ায় বিপিএলকে বদলে দিতে কাজ করছে বিসিবি ও খোদ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। টুর্নামেন্ট শুরু হতে এখনও চার সপ্তাহ বাকি থাকলেও এরই মধ্যে নানা কর্মকাণ্ডে দর্শকদের মন জয় করেছে বিসিবি। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিপিএলকে বদলে দিতে যেসব অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে বিসিবি।
১.তারুণ্যের উৎসব : ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ স্লোগানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শুরু হচ্ছে ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর বিপিএল দিয়ে এবং শেষ হবে ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রয়ারি সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী ফুটবলের ফাইনাল দিয়ে।
২. ডানা-৩৬ মাসকট : ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্মৃতিকে ধরে রাখতে মাসকটের নাম রাখা হয়েছে ‘ডানা ৩৬। যার দুই পাশে দুটি ডানা। এই মাসকটের নামের ডানা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। গত জুলাই-অগাস্টের গণ আন্দোলনের স্মরণীয় ৩৬ দিনের জন্য মাসকটের দুই পাশে ১৮টি করে রাখা হয়েছে মোট ৩৬টি রঙিন পালক। যা প্রতিটি স্বপ্নবাজ, উদ্যমী, অপ্রতিরোধ্য তরুণকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
৩.তিন শহরে কনসার্ট : আগামী ২৩, ২৫ ও ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে হবে বিপিএলের উদ্বোধনী কনসার্ট। ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে পারফর্ম করবেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি গায়ক রাহাত ফতেহ আলী। এর সঙ্গে স্থানীয়দের মধ্যে গাইবেন রুনা লায়লা ও মাইলস। পাশাপাশি আরো কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে বিসিবি। যদিও এর পুরোটা দেখভাল করছে প্রধান উপদেষ্টার অফিস। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ও সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের কনসার্টে থাকবেন না রাহাত ফতেহ আলী।
৪.থিম সং ও গ্রাফিতি: বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) থিম সং ও গ্রাফিতি প্রকাশ করেছে বিসিবি। ৩০ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া একাদশ বিপিএলের থিম সং লেখায় হাত লাগিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিপিএলের নতুন আসরকে ঘিরে তৈরি হওয়া থিম সংটি গেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পী মুজা। সেই সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন রায়েফ আল হাসান রাফা ও র্যাপার হান্নান হোসাইন। ২০২৫ আসরের থিম সংয়ের শিরোনাম ‘আবার এলো বিপিএল’। যার কয়েক লাইন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন। থিম সংয়ের পাশাপাশি বিপিএলের থিম গ্রাফিতিতেও ফুটে উঠবে জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার আন্দোলনের ছবি।
৫. বিনামূল্যে পানি ও জিরো ওয়েস্ট জোন: সাধারণত মাঠে বসে খেলা দেখতে গিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয় সমর্থকদের। বেশিরভাগ সময়ই অতিরিক্ত দামে খাবার কিনে খাওয়াসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। সেই সমস্যা সমাধানে এবার মুগ্ধ কর্ণারের মাধ্যমে বিনামূল্যে দর্শকদের জন্য পানির ব্যবস্থা করেছে বিসিবি। এছাড়াও গ্যালারির একপাশে থাকছে জিরো ওয়েস্ট ক্যাম্পেইন।
৬. ই–টিকিটের ব্যবস্থা : সশরীরে কাউন্টার থেকে বিপিএলের টিকিট পেতে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয় সমর্থকদের। যা নিয়ে নানা সময়ে উঠেছে টিকিট কালোবাজারির অভিযোগও। বিষয়টির সমাধানে অনলাইনে টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবি। ই-টিকিটের ফলে ন্যায্য দামে ও ভোগান্তি ছাড়াই পছন্দে টিকিট কিনতে পারবেন দর্শকরা।
৭. এলইডি বোর্ড স্থাপন : আইপিএল, পিএসএলের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে হরহামেশা এলইডি বোর্ডের ব্যবহার দেখা গেলেও, এদিক দিয়েও বেশ পিছিয়ে বিপিএল। বিষয়টির নজর এড়ায়নি বিসিবির। জমকালো উপস্থাপনে ব্র্যান্ডিংয়ে পেরিমিটার ও সাইড স্ক্রিণে স্ট্যাটিক বোর্ডের বদলে এলইডি বোর্ড স্থাপন করা হবে। যা বদলে দেবে দর্শকদের খেলার দেখার অভিজ্ঞতা।
৮. সেলিব্রেটি ও ইনফ্লুয়েন্সার সম্পৃক্ততা : বিপিএলের প্রচার-প্রসার বাড়াতে সেলিব্রেটি-ইনফ্লুয়েন্সারদের পাশাপাশি ক্রিকেটারদের সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা বিসিবির। কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের নিয়ে থাকবে বিশেষ আয়োজন। জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর এমন পরিকল্পনা অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার।
অলিম্পিকের মতো মেগা আসর কীভাবে আরও সুন্দর করা যায়, সেসব পরামর্শ নেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছ থেকে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের পরামর্শে এবার বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। যতদিন বিপিএল চলবে সব ক্রিকেটপ্রেমীরা বিপিএলের সাথে কানেক্টেড থাকবে। ব্র্যান্ডিংয়ের প্রয়াস থাকবে, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচারিত হবে, দেখবে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।