ছুটির দিনে
অপরূপ প্যাংগং লেক

প্যাংগং লেক, যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ফুট ওপরে হাজার হাজার রুক্ষ পাহাড় আর মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত বিধাতার এক বিশেষ আশীর্বাদ। এক নীল রঙেরই ক্ষণে ক্ষণে নানা রকম নীলের অদল-বদল আর বিস্তার। কখনো হালকা নীল, কখনো গভীর, কখনো আকাশি আর কখনো এক সবুজাভ নীল। কখনো মনে হবে পাথুরে পাহাড়ের সঙ্গে মিলেমিশে ধূসর আর নীলের এক নান্দনিক শেড।
আর এই নীল দেখতে আপনাকে যেতে হবে লেহ শহর থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরের প্যাংগং লেকের পাড়ে। যার অবস্থান ভারত আর চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায়। প্যাংগং লেকের বিস্তার ভারত ও চীনের ১৩৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে, যার ৪০ শতাংশ ভারতের আর বাকি ৬০ শতাংশ চীনের অন্তর্ভুক্ত। পুরো প্যাংগং লেক পাড়ি দিতে হলে আপনাকে ভারত ও চীনের প্রায় ৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। যেটা সম্ভব নয় আদৌ। অনেকে মনে করে, প্যাংগং লেক ভারতের ইন্দাস নদীর কোনো অংশ হয়তো। কিন্তু না, এটি কোনো নদীর অংশ নয়, বরং পাহাড় ও ভূমি দিয়ে আবৃত একটি বেসিন বা জলাশয় মাত্র। রুক্ষ পাহাড় ও মরুভূমির মাঝে বিধাতার বিশেষ আশীর্বাদ।
প্যাংগং লেক ও এর আশপাশের অঞ্চলের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৫-১০ ডিগ্রি, যেটা শীতে কখনো ২০-২৫ ডিগ্রি বা এর চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। সামারে যে লেকে টলটলে নীল জলরাশি, শীতে সেই লেক জমে বরফ হয়ে থাকে। তাই এখানে যেতে হলে পোড়াতে হবে বেশ কিছু কাঠখড়। বুনতে হবে অনেক দিনের স্বপ্ন, করতে হবে নিরন্তর চেষ্টা। তবেই পাবেন এমন দুর্লভ কোনো কিছুর দেখা, নীলের নানান রূপ।
পার্পেল ড্রিম বা প্যাংগং লেক যাওয়ার স্বপ্নটা প্রথম দেখেছিলাম সেই ২০১১ সালে থ্রি ইডিয়টস দেখার পর থেকে। পার্পেল মানে আমার কাছে অনেকগুলো রঙের সমন্বয়। যেখানে লাল-নীল-হলুদের পাশাপাশি থাকবে সাদা-কালো আর ধূসরের মিশ্রণ। সবকিছু মিলেই পার্পেল। পার্পেল মানে আমার কাছে অনেকগুলো রঙের একত্রীকরণ। যেমন এখানে যেতে হলে অনেক সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা সইতে হবে আপনাকে। এখানে চাইলেই হুট করে চলে যেতে পারবেন না আপনি। তাতে আপনার যতই টাকাপয়সা থাকুক না কেন?
প্যাংগং লেক যেতে হলে কখনো পাবেন ভীষণ আনন্দ, কখনো করতে হবে অনেক কষ্ট, কখনো পাবেন দারুণ উদ্দীপনা আর কখনো পেরোতে হবে নানা রকম বাধা। একা একা যাওয়া এখানে অনেক কঠিন বা অনেকটা অসম্ভবও বটে। তাই বেশ কিছু টাকাপয়সার সঙ্গে চাই ভালো, সহমতের কয়েকজন সঙ্গীও। তাই তো বলেছি, এখানে যাওয়াটা অনেক সাধনার আর শ্রমের পাশাপাশি, বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষও বটে।
তবে একবার পৌঁছে গেলে দেখবেন, নিজেকে নিজেই ধরে রাখতে পারবেন না উচ্ছ্বাস আর আনন্দে। নিজের ব্যক্তিত্ব বা রাশভারী গাম্ভীর্য হয়তো লোপ পেতে পারে কিছু সময়ের জন্য। দেখে ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝেমধ্যে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের আনাগোনা, আকাশের সঙ্গে মিতালি করে স্বচ্ছ, টলটলে লেকের জলের রং বদলের একান্ত খেলা। শোঁ শোঁ বাতাস, কনকনে ঠান্ডা, রুক্ষতা সত্ত্বেও আপনি উন্মাদ হয়ে যেতে চাইবেন এমন অপরূপ রূপের অবলোকনে। কখনো শিশু হয়ে দেবেন লাফঝাঁপ, কখনো চলে যাবেন দুরন্ত কৈশোরে, দৌড় দিতে ইচ্ছে হবে এখানে-সেখানে, কখনো ইচ্ছে হবে প্রেমিক হয়ে হাত দুটো প্রসারিত করে গাইতে প্রিয় কোনো গান। আর কখনো ছবি তোলার জন্য দিতে চাইবেন অসংখ্য পোজ, যার কোনো তৃপ্তি আপনি পাবেন না, তাতে যত ছবিই তোলেন না কেন।
শেষমেশ হয়তো উন্মাদনার খেয়াল ভাঙবে ড্রাইভারের হাঁকডাকে বা অন্য কোনো বন্ধুর আক্রোশে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখন যেতে হবে বলে। অথবা চাইলে থাকতেও পারেন এক রাতের জন্য, সেই ব্যবস্থাও আছে সেখানে। আছে বেশ ভালো মানের হোটেল, গেস্টহাউস আর তাঁবুর ব্যবস্থা। একটু দামি হলেও শ্বাসকষ্টের সমস্যা আর হাতে সময় থাকলে একটি বিকেল বা সন্ধ্যা কাটাতে থেকে যেতে পারেন এক রাত অনায়াসে। তবে অবশ্যই শীত ও প্রচণ্ড বাতাসের তোড় মোকাবিলার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে।
যাওয়া-আসা আর থাকা-খাওয়া
কলকাতা থেকে প্লেনে বা ট্রেনে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর বা লেহ। লেহ থেকে গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে প্যাংগং লেক যেতে প্রতিদিনের গাড়ি ভাড়া পড়বে তিন হাজার ৫০০ টাকার মতো। থাকার জন্য রুম বা তাঁবু পাবেন এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। আর ক্ষেতে পারবেন মাছ-মাংস ছাড়া অন্য সবকিছুই, মোটামুটি ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়।