ইউরোপের পথে পথে
ফ্রান্সের স্ট্রাসবুওরগে একদিন

বাংলাদেশের প্রকৃতি সবসময় আমাকে টানত এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। দেশে থাকতেই ভ্রমণপিপাসু ছিলাম। তাই সময় পেলেই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতাম।
স্বদেশ ছেড়ে এসেছি এক বছর হতে চলল। এখন জার্মানিতে। জার্মানিতে এসেও প্রকৃতি সবসময় আমাকে টানে এবং ছুটির দিন পেলেই বিশেষ করে রোববারে কোথাও না কোথাও ঘুরতে বের হই। রোববার সকালে জানতাম না কোথায় যাচ্ছি এবার ঘুরতে। আমার মি. বললেন আমরা ফ্রান্সের স্ট্রাসবুওরগ শহরে ঘুরতে যাব।
যেভাবে যাত্রা শুরু
জার্মানির মানহাইম শহর থেক স্ট্রাসবুওরগ যেতে গাড়ির নেভিগেশনে দেখাচ্ছে, সময় লাগবে এক ঘণ্টা ২৫ মিনিট। আমি অবাক হলাম এবং হচ্ছি অনবরত অনেক কিছুতেই। সকালের নাস্তা যথারীতি গোয়ের্টস নামক চেইন শপে সেরে সাড়ে ১১টার দিকে। এরপর হাইওয়ে রোডে উঠলাম। তবে গোয়ের্টসের নাস্তা খুব সুস্বাদু এবং অপেক্ষাকৃত অনেক সস্তা। রোববার সকালে এখানে প্রচুর ভিড় দেখা যায়। জার্মানির প্রায় প্রত্যেকটা শহরে এদের অনেক শাখা আছে।
এখানে হাইওয়ে রোড কে আউটোবান বলে এবং নম্বর দেওয়া থাকে। শীতের আগমনে চারপাশের প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন হয়েছে। কয়েকদিন আগেও চারপাশে সবুজ, হলুদ আর লালের সমারোহে মোহনীয় রূপ ছিল। এখন সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছগুলো ন্যাড়া হয়ে গেছে অধিকাংশ। তারপরও দুইপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। জার্মানির নয়েস্টাড শহরকে ডানে রেখে সোজা যাচ্ছি ল্যান্ডডাউ শহর হয়ে। নয়েস্টাডের হাম্বাখার শ্লস প্রাসাদটা দূর থেকেই চোখে পড়ল।
হাইওয়ে রোড ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় দুই পাশের দিগন্তবিস্তৃত। আর বিভিন্ন সবজি, শস্যক্ষেত চোখে পড়ল। হঠাৎ দেখি একটি ক্ষেতে দেড়শ থেকে দুইশটির মতো মিষ্টি কুমড়া পড়ে আছে। আমি বেশ উত্তেজিত হয়েই শুনলাম, এগুলো নাকি ক্ষেতের মালিকরা ফেলে চলে গেছে। আমি অবাক হলাম যে, এতগুলো কুমড়া ফেলে গেছে তারা। কুমড়াগুলোর আকৃতি একটু ছোট বড় বা হয়তো একটু সমস্যার কারণে এগুলো ফেলে গেছে তারা। কারণ এগুলো সুপার শপে নিবে না এ জন্যই। তবে আগে কিছু তুর্কি বা গরিব কুঁড়িয়ে নিত। এখন আর কেউ নেয় না।
আমি অপেক্ষায় আছি কখন ফ্রান্সের বর্ডার আসবে। হঠাৎ একটি গ্যাস স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার ওপর গন্তব্যের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল এবং গ্যাস স্টেশনে দাঁড়ানো একটা গাড়ীতে দেখলাম Police লেখা। জার্মানিতে পুলিশের গাড়ীতে Polizei লেখা থাকে।। এর পরই রাস্তার দুই পাশের রোড সাইন, ল্যান্ড মার্ক এবং প্রতীকগুলো বদলে গেল। জায়গাটার নাম শাইবেনহার্ড বুঝার আগেই বর্ডার পার হয়ে ফ্রান্সে ঢুকে গেলাম। চারপাশের দৃশ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে ঘুরার মজাই আলাদা। সেনজেনভুক্ত হলো এক ভিসায় ইউরোপের ২৬টি দেশ ঘুরা যায়। আর জার্মানির চারপাশে এতগুলো দেশের বর্ডার যে দিনে তিনটা দেশে যাওয়া সম্ভব।
মজার ব্যাপার, শাইবেনহার্ড নামক জায়গা দিয়েই ফ্রান্সে ঢুকলাম এবং দুই দেশে একই নাম হলেও জার্মানিতে বানান Scheibenhardt আর ফ্রান্স অংশে নামের বানান Scheibenhard।
অবশেষে চলে এলাম ফ্রান্সের স্ট্রাসবুওরগে। মনে হলো, ঢাকা থেকে গাজীপুর এলাম। ইউরোপের প্রতিটা শহরের একটা সেন্টার পয়েন্ট থাকে যেখানে গাড়ি চলাচল নিষেধ থাকে। বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন শপিংমল ও খাবারের দোকান থাকে কিন্তু সেখানে হাঁটা বাধ্যতামূলক। এই রাস্তাগুলোকে ফুসগ্যাংগারজোন আর জায়গাটাকে মার্কটপ্লাটস বলে। স্ট্রাসবুওরগের সৌন্দর্য
শহরের কেন্দ্রের দিকে এগুতেই ট্রামগুলো চোখে পড়ল। ফ্রান্সের স্থাপত্যকলা প্রাচীন কাল থেকেই নন্দিত। প্রতিটা বাড়ি,রাস্তা এমনকি রাস্তার পাশের ডাস্টবিনগুলোও জাঁকজকমক পূর্ণ। কয়েকশ বছরের পুরোনো বাড়িঘর দেখলেই তা বুঝা যায়। আমরা রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে হাঁটা শুরু করলাম। ঝলমলে রোদ থাকলেও তাপমাত্রা সাত ডিগ্রির নিচে ছিল। রোববার ছুটির দিন তাই দোকানপাট সব বন্ধ ছিল। ফুসগ্যংগারজোনে গিয়ে প্লেস ক্লেবার চত্বরে পৌঁছালাম। সেখানে জেনারেল ক্লেবারের সমাধি ও ভাস্কর্য ছিল।আর কিছুদূর এগিয়েই বিশালাকার এবং অপরূপ স্থাপত্যশৈলীর রোমান ক্যাথলিকদের স্ট্রাসবুওরগের ক্যাথেড্রালের সামনে চলে এলাম। কি যে অপূর্ব, না দেখলে আন্দাজ করা কঠিন। এটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ষোড়শ শতাব্দীর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি এবং রোজ উইন্ডো।
এর ভিতরের রঙিন গ্লাসের শিল্পকলা ছোট ছোট অসংখ্য ভাস্কর্য আর ঘণ্টা বা দেয়াল সংলগ্ন মিউজিক্যাল স্থাপত্য রয়েছে। আমি কোনটা রেখে কোনটা দেখব আর ছবি তুলব বুঝে পাচ্ছিলাম না। সত্যি ই অপূর্ব জায়গা। সময়ের অভাবে উপরে উঠি নাই। স্ট্রাসবুওরগের ক্যাথেড্রালের চারদিকের দৃশ্য ভিন্নরকম। বিশাল চত্বরে অবাক বিশ্বয়ে ক্যাথেড্রালের দিকে তাকিয়ে থাকা একটি ওয়্যারউল্ফ টাইপের ভাস্কর্য ও বেশ নজর কাড়ে।
আসন্ন বড়দিন উপলক্ষে সারা ইউরোপে সাজসাজ রব। স্ট্রাসবুওরগ শহর সেজে উঠছে। সব রাস্তাঘাট, বাড়ি, ডেকোরেশন পিস, নানান ধরনের আলোকসজ্জা ও ক্রিস্টমাস ট্রি দিয়ে সেজেছে শহরটি। ইউরোপের অনেক শহরের চেয়ে বড়দিনের সাজে স্ট্রাসবুওরগের সৌন্দর্য বেশি সুন্দর ।
বাটোরোমাতে ইল নদীতে ভ্রমণ
ক্যাথেড্রালের পাশেই পর্যটক অফিস থেকে আমরা পুরো স্ট্রাসবুওরগ শহর ঘুরে দেখার জন্য এবং শহরের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘ইল’ নদীতে ভ্রমণের জন্য নৌকার টিকিট কাটলাম। টিকিট কাটার সময় নৌকায় কয়টা আসন আছে তা সনইনফোতেই পাওয়া যায়। নৌকাগুলো ছিল শীতাতাপ নিয়ন্ত্রতিত। রোদ থাকলে ওপরে শাটার টানা যায় যা দেখতে দারুণ। নৌকায় ১০২ জনের বসার ব্যবস্থা আছে এবং প্রত্যেকটা আসনের সাথে হেডফোন আছে। হেডফোন দিয়ে ইংলিশ এবং ইউরোপিয়ান ভাষায় শোনা যায় বা যে যেই ভাষাতে শুনতে চায় সেই ভাষাতেই শুনতে পাবে। আমারা নৌকায় ভ্রমণের সময় পেলাম দুপুর সাড়ে ৩টাম। তাই হাতে কিছুটা সময় থাকায় একটু অলি গলি ঘুরলাম। এক কাপ কফি পান করার পর কাগজের ঠোঙ্গায় বাদাম জাতীয় ফল ‘মারুনী’ কিনেছিলাম। গরম গরম কয়েকটা ‘মারুনী’ খেয়ে বাকিটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই সি নাম্বার জেটিতে অপেক্ষারত বাটোরমা নামক নৌকায় উঠলাম। তবে আমাদের আরো আগেই আসা উচিত ছিল তাহলে নৌকার সামনে বসতে পারতাম। তাহলে আরো ভালোভাবে দেখতে ও ছবি তুলতে পারতাম।
এটি ছিল এক ঘন্টার রাউন্ড ট্রিপ। নৌকার পুরোটা ছিল গ্লাস দিয়ে ঘেরা স্বচ্ছ। নদীর দুই দিকের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন স্থাপনার বর্ণনা শুনছি এবং আর রাস্তার দুই ধারে দাঁড়ানো সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় কৌতূহলী পর্যটকদের হাত নাড়িয়ে হাই দেওয়া হয়।
কিছুদূর যাওয়ার পরই একটা সেতু খুলে গিয়ে নৌকা যাওয়ার সুযোগ করে দিল আবার আমাদের নৌকাটা এগিয়ে গেলে আবার স্টিলের সেতুটা বন্ধ হয়ে গেল। খুব মজা লাগল দেখে। ফ্রান্সের এত ছোট বড় সেতু শহরের মাঝখানে যার প্রত্যেকটারই ইতিহাস আছে। প্রাচীন কালের চকলেট ফ্যাক্টরিও দেখলাম। কয়েদি রাখা হতো এমন অনেক (সম্ভবত ১১টা) টাওয়ার, গির্জা আরো কত কী যে দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতে যাচ্ছি, ডানে বামে কোনটা কী আর সেতুর ইতিহাস। এই নৌকাভ্রমণ প্যারিসেও আছে আইফেল টাওয়ারের নিচ থেকে ছাড়ে। আরো মুগ্ধতা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য।হঠাৎ নৌকাটি থেমে গেল একটা গলির মতো জায়গায়। সামনে একটা সেতু। কী হলো প্রথমে বুঝতে পারিনি। হাসির সাথে পাশ থেকে শুনলাম, আরে এটা তোমার সেই প্রিয় শ্লয়েজে। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম নৌকাটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। তার মানে নদীর যে প্রবাহে আছি সেটা সামনের প্রবাহের চেয়ে নিচে (১.০৮ মিটার)। নৌকাটি একটা ছোট্ট টানেলের মতো জায়গায় আটকে সামনে পিছনের গেট লক করে, পানি পাম্প করে দিয়ে উপড়ে তুলে সামনের গেট টা খুলে গেল তারপর আবার চলতে লাগলাম।
বেশ খানিকটা যাওয়ার পর আবার নিম্নমুখী প্রবাহে যাওয়ার সময় একই কায়দায় নৌকাটি সরু একটা টানেলে ঢুকে সামনে পিছনের গেট বন্ধ করে পানি আটকে পাম্প করে বের করে দিয়ে পানির লেভেল ১.৮ মিটার নামিয়ে তারপর সামনের গেট খুলে গেল। ইংলিশে স্লুইস গেট বলে হয়তো। আমি খুব ছোটবেলায় এই গল্প শুনেছিলাম জাহাজে চাকরি করা আমার এক আত্মীয়র কাছে। কয়েক মাস আগে জার্মানির হিয়েরশহর্ন নামক জায়গায়ও দেখেছি এভাবে বড় বড় জাহাজ যেতে। সারা ইউরোপে সব পাহাড়ি নদী বা উঁচু-নিচু নদীতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বড় বড় জাহাজ চলাচল করে। আমি তো মহা খুশি আর এই জায়গাগুলোতে রাস্তার উপরে পর্যটক বেশি। সবাই মনযোগ দিয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে। সময় থাকলে আমিও রাস্তা দিয়ে যেয়ে উপর থেকে দেখতাম।সামনে না বসতে পারার জন্য ও দু:খ লাগল।এক সময় একটা অতি আধুনিক স্থাপত্যসমূহের সামনে চলে এলাম। শুনলাম ডান পাশে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, বিশাল বিশাল ভবন,বামে ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট,ডানে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে আছে আরেক জটিল স্থাপনা “European Court of Human Rights” ভবন। আর মাথার উপরে গাংচিল গুলো উড়ছে। আবহাওয়াটা ঠান্ডা হলেও রৌদ্রজ্জ্বল বলে সবকিছুই ভালো লাগছিল। নদীর ধারেই টিভি চ্যানেলের সুবিশাল ভবন দেখলাম। এই চ্যানেলটি জার্মানিতেও দেখা যায়। আরো বহু স্থাপনা আর একটা বিশাল শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেখে PALAIS ROHAN এর পাশের যেখান থেকে উঠেছিলাম সেই জেটিতে ফিরে এলাম। একদিনের জন্য কয়েক ঘণ্টার ট্রিপ এ অনেক প্রাপ্তি হলো।
স্ট্রাসবুওরগের আদি নাম আলাস্কা। এখনো কোথাও কোথাও এর নাম উল্লেখ আছে। আদি ও বর্তমান দুই ঐতিহ্যই আছে। প্রাচীন স্থাপত্যকলা অলিতেগলিতে হেঁটে বেড়ালেই বুঝা যায়, একটা কেমন যেন শিহরণ খেলে যায়। তার উপড় আসন্ন ক্রিসমাস এর সৌন্দর্যবর্ধন যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই এখানে অসংখ্য পর্যটকদের ভিড়। বর্তমানে এটি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ফরমাল সিট ।এখানে MEP(Member of the European Parliament) এর ভোট হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জৌলুশপূর্ণ ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে যেখানে চার দিনব্যাপী ১২টা বৈধ সেশন হওয়া বাধ্যতামূলক।
ইউরোপে এখন বিকেল সাড়ে ৪টা বাজতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। ভেবেছিলাম আলোকসজ্জাগুলো জ্বলবে। নিরাশ হতে হলো। ডিসেম্বরে সব সাজানো শেষ হবে। হয়তো পহেলা ডিসেম্বর থেকে সব জ্বল জ্বল করে আলোকিত হবে। এখানে অনেক রকম রেস্টুরেন্ট আছে। এক জায়গায় চাপটির মতো বানিয়ে তার উপড় চকোলেট দিয়ে (প্যানকেকের মত) দেদারস বিক্রি হচ্ছে। লাইন ধরে কিনছে সবাই। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ম্যাকডোনাল্ডস খেয়ে বাসার দিকে জার্মানিতে ফিরতি পথ ধরলাম।স্ট্রাসবুওরগের ভ্রমণের এখানেই সমাপ্তি। আবার হয়তো যাব হুট করে যেকোনো সময়। ইউরোপের ভাজে ভাজে উপভোগ করার বহু কিছু আছে। ইউরোপে থাকলে সুযোগ পেলে ঘুরে আসুন এসব জায়গায়।
প্রবহমান জলে শ্যাওলা জমে না, হ্যাপি ট্রাভেলিং।