ছুটির দিনে
১২০০ টাকায় তাজহাট জমিদারবাড়িতে

শত বছরের অমলিন কীর্তি রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি। কালের পরিক্রমায় আমাদের অনেক কীর্তি হারিয়ে গেলেও এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাজহাট জমিদারবাড়ি। শহর থেকে কিছুদূরেই এর অবস্থান। রিকশায় যেতে আধা ঘণ্টার মতো সময় লাগে। রংপুর শহরের তাজহাট জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক। শহরের কাছেই ইতিহাস সংগ্রহশালার ঐতিহাসিক প্রাসাদটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
ইতিহাস
তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্না লাল রায়। তিনি পাঞ্জাব থেকে এসে রংপুরের মাহীগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহীগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা শহর। কথিত আছে যে, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্না লাল রায়ের আকর্ষণীয় 'তাজ' আর 'রত্ন'খচিত মুকুটের কারণে এ এলাকার নামকরণ হয় তাজহাট। জীবদ্দশায় তিনি বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক হন। রংপুরের অনেক এলাকা তার আয়ত্তে আসে। বংশ পরম্পরায় মান্না লাল রায়ের নাতি ধনপতি লাল জমিদার হন। ধনপতি রায়ের নাতি উপেন্দ্র লাল রায় জমিদারি গ্রহণের পর অল্প বয়সে মারা যান। তখন জমিদারির দায়িত্ব তার কাকা 'মুনসেফ' গিরিধারী লাল রায়ের হাতে আসে। তিনি নিঃসন্তান হওয়ার কারণে কলকাতার গোবিন্দ লালকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন।
গোবিন্দ লাল ১৮৭৯ সালে এই জমিদারির উত্তরাধিকারী হন। পরে তিনি ১৮৮৫ সালে রাজা, ১৮৯২ সালে রাজাবাহাদুর এবং ১৮৯৬ সালে মহারাজা উপাধি লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে তিনি মারা যান। ১৯০৮ সালে তার ছেলে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় রাজবাড়ির মালপত্র গুছিয়ে ট্রেনে ভারতে যাওয়ার সময় কুষ্টিয়ায় হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছেলেমেয়েরা তাঁর লাশ ও মালপত্র নিয়ে ভারতে চলে যান। এখন রাজবাড়িতে জমিদার আমলের কাঠের একটি টেবিল-চেয়ার ও ঝাড়বাতির অংশ আছে কালের সাক্ষী হয়ে। মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান ভবনটির নির্মাণ শুরু হয়। দক্ষ নকশাকার ছাড়াও সব মিলিয়ে কাজ করেন প্রায় দুই হাজার রাজমিস্ত্রি। ১৯১৭ সালে ভবনটি সম্পূর্ণ হয় এবং সে সময়ের হিসেবে এতে খরচ হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। ইতালি থেকে আমদানিকৃত শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ বাড়ির সম্মুখ সিঁড়িটি। এ ছাড়া ভবনের প্রধান প্রধান অংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লাল ইট, শ্বেতপাথর ও চুনাপাথর।
যা দেখবেন
ফটক পেরিয়ে ১০০ গজের মতো দূরত্বে রাজবাড়িটি। প্রধান রাস্তা থেকে বেরিয়ে একটি ছোট রাস্তা সামান্য বাঁক নিলেই পেয়ে যাবেন রাজবাড়ীর দেখা। রাস্তার দুই পাশে আকাশসম উচ্চতার নারকেল গাছ। বাড়িটির সামনে ও পাশে দেখা পাবেন দুটি পুকুরের। সব মিলিয়ে ৯৬ একরজুড়ে বিশাল এ রাজবাড়ি। বাড়ির সামনেই বিশাল বাগান। রাজবাড়ি আর বাগান বাদে পুরো অংশেই রয়েছে বাগান। নরম সবুজ ঘাস আবৃত করে রেখেছে ফুলের বাগান। দোতলা প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ৭৬ দশমিক ২০ মিটার। এটির ভূমি নকশা ইংরেজি ইউর মতো। এখানের ব্যবহৃত মার্বেল পাথরগুলো ইতালি থেকে আনা । বাড়িটির সামনের দিকে দুই প্রান্তে ও মধ্যভাগে উঁচু বারান্দা রয়েছে। একটু এগিয়ে গেলে দেখা পাবেন মিউজিয়ামের এখানে সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন হস্তলিপি, পুরাতন পত্রিকা (রংপুর দর্শনা ২৪ নবেম্বর ১৯২৪),শিব-পার্বতীর মূর্তি, মাটির পাত্র, বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক, পুর্বকার রাজা বাদশাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র বা মৃৎপাত্র, প্রজা বিদ্রোহের নেত্রী সরলা দেবীর ব্যবহৃত সেগুনকাঠের বাক্স, মঙ্গলকোট ও সীতাকোট (বগুড়া), মহাস্থানগড় থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক, নারীমূর্তি, লোহার দ্রব্যাদি, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, লাল পাথরের টুকরো, পাহাড়পুর বিহার থেকে সংগৃহীত নারীমূর্তি, পাথরের নুড়ি, বদনা, আক্রমণ উদ্যোত যোদ্ধার মূর্তি প্রভৃতি। সাহিত্য পরিষদ রংপুর কর্তৃক সরবরাহকৃত হাতের লেখা মহাভারত, রামায়ণ, চেতন্যচারী অমৃত, শান্তি শতক, গাছের বাকলে লেখা সংস্কৃত হস্তলিপি, বেগম রোকেয়ার স্বহস্তে লেখা চিঠি, তুলট কাগজে লেখা হস্তলিপি, সম্রাট আওরঙ্গজেব, কবি শেখ সাদী, বাদশা নাসির উদ্দিনের স্বহস্তে লেখা কোরআন শরীফ, ছোট্ট কোরআন শরীফ এখানে সংরক্ষিত রয়েছে।
প্রদর্শনীর সময়
বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জাদুঘরটি সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শীতকালে বা অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সপ্তাহের রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবসসহ সরকারি সব ছুটির দিনে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেন ও বাসে রংপুর যাওয়া যায়। রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন পরিবহনের বাস যেকোনো সময় রংপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এসি, নন-এসি ভেদে প্রতি যাত্রীর ভাড়া পড়বে ৫৫০-১২০০ টাকা। তবে কুড়িগ্রামের বাসে উঠলে জাদুঘরের ঠিক সামনে নামা যায়। তা ছাড়া রংপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে জাদুঘর যেতে ২০ টাকা ভাড়ায় রিকশা পাওয়া যায়। আর অটোতে গেলে ১০ টাকা লাগে।