ঈদের ছুটিতে
মন মাতানো মুন্নার

কেরালাকে বলা হয় ‘গডস ওন হোম’ বা ‘বিধাতার নিজের বাড়ি!’ কিছুদিন আগে কেরালা আর মুন্নার গিয়েছিলাম আর মনে মনে খুঁজে দেখার আর বোঝার চেষ্টা করেছিলাম যে কেন কেরালা বা মুন্নারকে ‘বিধাতার নিজের বাড়ি’ বলা হয়?
তো, যখন কেরালার অপূর্ব রেলস্টেশন ইরনাকুলাম থেকে মুন্নারের দিকে বাসে করে যাচ্ছিলাম, বাস সমতল থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা আর উঁচু পথ ধরতেই, ধীরে ধীরে অনুভব করতে লাগলাম যে কেন এই জায়গাকে বিধাতার নিজের বাড়ি বলা হয়? কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এরপর ঠিক মনে নেই। ঘুম ভাঙল যখন সমতল ছেড়ে পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করেছিলাম। এক পাহাড়ি বাসস্ট্যান্ডে বাস থেমেছিল ১০ মিনিট বিরতিতে। এর পরেই শুরু হয়েছিল মুন্নার যাওয়ার মনোমুগ্ধকর রাস্তা।
আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে উপরে উঠি আর সবুজের অরণ্য ভেদ করে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে সামনে এগোতে থাকি। একপাশে সবুজের সমুদ্র ঢেউখেলানো চা বাগান, তার একটু উঁচুতে গভীর আর ভেজা অরণ্য, অন্যপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট-বড় নানা রকম রুপালি ঝর্ণা, সাদা মেঘের ভেলা, কাছে দূরে কুয়াশার নিজের মতো করে খেলা। এক অপরূপ আবেশ তৈরি করে দিয়েছিল মুহূর্তেই।
আর হুট করেই বেশ ঠান্ডা লাগায় মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখি, দুপুরের ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা কখন যেন কমে ১৭-তে চলে এসেছে। মানে উত্তপ্ত গরম থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে শীতের দেশে চলে এসেছি। বাহ, কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার, তাই না? যদিও এমন অভিজ্ঞতা আমি দার্জিলিংয়ে বহুবার পেয়েছি, কিন্তু ওরা এবারই প্রথম তাই আমার চেয়ে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত ছিল। গরমে মা-ছেলের গোমড়া মুখে শীতের সুখ পরশ বুলিয়ে দিয়েছিল মুন্নার যাওয়ার পথের সবুজের সমুদ্র, ঢেউখেলানো চা বাগান, গভীর আর অচেনা অরণ্য, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কাছে দূরের ছোট বড় পাহাড়, পাহাড়ে পাহাড়ে জমে থাকা মেঘের দল, মাঝেমধ্যে বাসের খোলা জানালা দিয়ে আঁকড়ে ধরা শীতের কুয়াশা আর পাহাড়ের গা থেকে ঝরে পড়া অসংখ্য রুপালি ঝর্ণাধারা।
মুন্নারে পৌঁছে সন্ধ্যায় ফ্রেশ হয়ে শহর দেখতে বেরিয়েই অবাক। কী ঝলমলে এক একটা দোকান, চায়ের ফ্যাক্টরি আউটলেট, কফির শপ, চকলেটের দোকান আর ভিন্ন রকম চকলেটের বিকিকিনি। এক একটা দোকানে ঢুকি আর চা, কফি, চকলেটের গন্ধে প্রাণ ভরে যায়। এতোই বিশুদ্ধ সেই গন্ধ, মনে হচ্ছিল মুখ হা করে রাখি আর বুক ভরে বিশুদ্ধ খাটি কফি আর চকলেটের গন্ধ নিয়ে নেই যতটা পারি। আর চোখে পড়ল অন্য রকম এক সাবানের আয়োজন, পাতা আর কোনো একটা গাছের বাকলের মধ্যে আয়ুর্বেদিক সাবানের সমারোহ।
চা, কফি, সাবান আর চকলেটের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল এক একটা বর্ণিল দোকানে নানা রকম বর্ণিল চকলেট দেখাটা। সেটাও চকলেটের প্যাকেট নয়, একেবারে চকলেট। কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে। সাদা, লাল, কফি, আর রং-বেরঙের নানা রকম চকলেট। গামলায় গামলায় সাজিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। দেখেই মন ভরে গেছে। আর মানুষ কিনেছেও দেদার।
রাতের মুন্নার ছিল গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, পাহাড়ে পাহাড়ে, ফুলে ফুলে, ঝর্ণাধারায়, পাহাড়ি নদীতে বৃষ্টি ঝরা, বৃষ্টি জড়ানো, বৃষ্টিময়। কিন্তু সকালের মুন্নার? একদম অন্য রকম মুগ্ধতা ছড়ানো। খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙে ছিল। আগের দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মুন্নারের যে স্নিগ্ধ সবুজ রূপ দেখেছিলাম, সকালে সেই সবুজে সূর্যের প্রথম আলো পরে চারদিক যেন হলুদ রঙে সেজে উঠেছিল। সবুজ কচি পাতায়, সূর্যের প্রথম স্পর্শে একটা হলুদের ঢেউ ওঠে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নাম না জানা অনেক রকমের আর রং-বেরঙের ফুল হেসেছিল সূর্যের ছোঁয়া মেখে। পাহাড় আর অরণ্যের ফাঁক গলে ঢুকে পরা শীত সকালের প্রথম সূর্যের উষ্ণ পরশ একটা অন্য রকম আরাম দিচ্ছিল।
এরপর আলো এলো আকর্ষণ। মুন্নারের চা বাগান। চা বাগান তো অনেক দেখেছি আগে। কিন্তু এমন ঢেউখেলানো, এমন আকৃতির আর আকর্ষণীয় চা বাগানের আগে কোনো দিন দেখিনি। দেখেছি শুধু মুন্নারের ছবিতে আর সিনেমার নাচে-গানে। কিন্তু আজ যে একদম হাতের নাগালে, চোখের সামনে, ক্যামেরার ক্লিকে। ইচ্ছে হলেই নেমে পড়া যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়া যাচ্ছে, আর প্রাণভরে ওর রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করা যাচ্ছে। পাগল করা মুহূর্তগুলো যতটা সম্ভব ধরে রাখতে কখনো ক্যামেরা আর কখনো মোবাইলে ধারণ করে রাখছিলাম। সেই হলুদ-সবুজ আর সোনালি স্নিগ্ধ চা বাগানে অনেক অনেকক্ষণ কাটিয়েছিলাম।
মুন্নারের নাকি কোনো আজেবাজে কীটপতঙ্গ বা মশা-মাছি নেই, যে কারণে সেখানে কারো তেমন রোগ-বালাইও হয় না। আর তাপমাত্রা সব সময়ই ১৫ থেকে ২৫-এর মধ্যে থাকে, শুধু শীতের সময়টুকু ছাড়া, যা দারুণ আরামদায়ক। এই সবকিছু মিলেই কেরালা বা মুন্নারকে বলা হয় ‘বিধাতার নিজের বাড়ি’।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কলকাতা বাস বা ট্রেন। কলকাতা থেকে প্লেন বা ট্রেনে কেরালা। তবে প্লেন বা ট্রেনে যেভাবেই যান, কম খরচে যেতে চাইলে অবশ্যই বেশ আগে টিকেট করতে হবে। কেরালা থেকে বাসে চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ মুন্নার ভাড়া মাত্র ১১৬ রুপি।
থাকা-খাওয়া
থাকতে পারবেন এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে আধুনিক সব সুবিধাসহ তিনজনে আরামে। আর খাওয়া-দাওয়ার সবই পাবেন সাধ্যের মধ্যেই।