হিটলারের নৃশংসতার সামনে একদিন
বরাবরের মতোই আমার স্বামীর খুবই অনাগ্রহ কষ্টের কিছু দেখার ব্যাপারে। তাঁর মতে, কোথাও বেড়াতে গিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ফেরত আসাটা মোটেই যৌক্তিক নয়। নিজের জীবনেই তো দুঃখের শেষ নেই!
তাঁর যুক্তি যা-ই হোক, আমি এত কাছে এসে ইতিহাসের অংশগুলো না দেখে চলে যাওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারিনি।
পোল্যান্ডে আছি ছয় মাসের ওপরে। আসার পর থেকেই ভাবছিলাম, অশউইচ যাব। একদিন গিয়েছিলামও; কিন্তু দরজার বাইরে লম্বা লাইন দেখে ফিরে আসতে হয়েছিল।
পোল্যান্ডের অনারারি কনসাল ওমর ফারুকের ব্যবস্থা করে দেওয়া বুকিংয়ের সুবাদে বহুদিন পর এবার আমরা প্রায় ৩৮ জন চললাম অশউইচের উদ্দেশে।

আমরা গিয়েছিলাম জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। ইউরোপজুড়ে তখন গ্রীষ্মের উৎসব। কিন্তু কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের ভেতরে পা দিতেই বুঝলাম, কী শীতল আর স্থবির এর ভেতরটা। বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। কনসেনট্রেশান ক্যাম্প... এটি সেই ধরনের জায়গা, যেখানে রাজনৈতিক বন্দি কিংবা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, ভিন্ন মতবাদের কিছু মানুষকে একেবারেই স্বল্প সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এক জায়গায় রাখা হয়। কনসেনট্রেট বা গাদাগাদি করে রাখা হয় বলেই হয়তো এর নাম কনসেনট্রেশান ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে বসবাসকারীদের সহ্য করতে হয় অমানুষিক অত্যাচার, ক্ষুধার কষ্ট, হাড়ভাঙা খাটুনি আর সবশেষ বীভৎস কায়দায় মৃত্যু।
এ তো গেল আক্ষরিক অর্থ। কিন্তু এর ভেতরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। গাইড স্পষ্ট উচ্চারণে বলে চলেছিল সেইসব দিনের কথা।
Arbeit Macht Frei – worksets you free! এই প্রহসনমূলক বাক্য দিয়েই শুরু ক্যাম্পের। প্রহসন, কারণ এ কাজ কখনোই এখানকার কয়েদিদের মুক্তি দিত না।

হিটলার বাহিনীর ইহুদিবিদ্বেষ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই। পৃথিবীর নানা সমস্যা আর মূলত জার্মান জাতির সব সমস্যার মূলে আন্তর্জাতিক ইহুদি চক্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করতেন হিটলার। যুদ্ধ শুরু হলে জার্মান সেনাবাহিনী প্রায় পুরো ইউরোপই দখল করে ফেলে। ইউরোপে তখন প্রায় এক কোটি মানুষ ইহুদি। আর এই ইহুদিদের মেরে ফেলার জন্য ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনী পুরো ইউরোপে গড়ে তোলে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বা ডিটেনশান সেন্টার অথবা হিটলারের বধ্যভূমি।
অশউইচ, দক্ষিণ পোল্যান্ডের এই জায়গাটি সমগ্র ইউরোপের মাঝখানে পড়ে যাওয়ায়, সব দেশ থেকে ইহুদিদের নিয়ে আসা সহজ হতো। ক্যাম্পের ভেতরে থাকা এক ম্যাপে দেখানো হয়েছে, কীভাবে পুরো মহাদেশ থেকে কোন কোন পথে এই ক্যাম্পে নিয়ে আসা হতো বন্দিদের। বিশ্বের প্রতি ছয়জন ইহুদির মধ্যে একজনকে এ সময় মেরে ফেলা হয়। শুধু যে ইহুদিদের মেরে ফেলা হয়েছিল তা নয়, সোভিয়েত যুদ্ধের বন্দি, পোলিশ জনগণ, জিপসি, সমকামী, শারীরিক অথবা মানসিকভাবে দুর্বল কিংবা অক্ষম ব্যক্তিদেরও বাঁচার অধিকার দেওয়া হয়নি।

অশউইচে মূলত তিনটি কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ছিল। অশউইচ ১, অশউইচ ২/বির্কেনাউ ও অশউইচ ৩/মোনোভিচ। আর ছিল প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি সাব-ক্যাম্প। আমরা গিয়েছিলাম অশউইচ ১-এ।
প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার পরই চোখে পড়বে ছোট ভবনগুলো অনেকটা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাইডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এর একেকটিতে প্রায় ৭০০ জন বন্দিকে গাদাগাদি করে রাখা হতো। বিভিন্ন রুমে টানানো রয়েছে সে সময়কার বেশ কিছু স্থিরচিত্র।
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কর্মক্ষম আর অক্ষম নারী-পুরুষদের দুই ভাগে ভাগ করা হতো। কর্মে অক্ষম নারী-পুরুষ-শিশুদের শুরুতেই মৃত্যুবরণ করতে হতো আর বাকিরা চলে যেত কাজের বিনিময়ে মুক্তির আশায়।

অশউইচে ঢুকেই আমাদের প্রথমে যেই দালান দেখানো হয়, তার সামনে দাঁড় করিয়েই কর্মক্ষম এসব নারী-পুরুষের রোল কল করা হতো। রোল নম্বরগুলো প্রত্যেকের গায়ে স্থায়ীভাবে লেখা থাকত। আর কে কোন গোষ্ঠীর, তা বোঝার জন্য কাপড়ের ওপরে সেলাই করা থাকত বিভিন্ন রঙের ছোট ত্রিভুজ। যেমন ইহুদিদের জন্য হলুদ রঙের ত্রিভুজ, অপরাধীদের সবুজ রঙের ত্রিভুজ ইত্যাদি।
এর পর তাদের স্থানীয় বিভিন্ন কারখানায় সারা দিন কাজ করানো হতো।
খাবার বলতে সকালে এক কাপ কালো কফি, দুপুরে এক বাটি সবজির স্যুপ, সন্ধ্যায় এক টুকরা পাউরুটি আর মাখন। বন্দিদের পানি দেওয়া হতো না, কারণ এতে বারবার টয়লেটে যেতে হবে। ফলে কাজের সময় নষ্ট হবে। গোসলের সুযোগ ছিল সপ্তাহে মাত্র একবার। এ ছাড়া ক্যাম্পে নেওয়ার পরপরই বন্দিদের চুল কেটে ফেলা হতো। এরপর সেই চুল দিয়ে তৈরি হতো সৈন্যদের কোট আর কম্বল।
কোনো ধরনের কথা অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বন্দিদের ডার্ক সেলে পাঠানো হতো। অন্ধকার ঘর, যেখানে একটা ছোট ছিদ্রের মতো জানালা। ডার্ক সেলে বন্দিরা দিনের পর দিন খাবার, পানি আর অক্সিজেনের অভাবে একসময় মারা যেত।

আবার অনেক নারী ও শিশুকে শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণার বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছলে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ঢুকিয়ে, একজনের হৃৎপিণ্ড অন্যজনের শরীরে লাগিয়ে, যমজ শিশুদের একজনের অঙ্গ আরেকজনের শরীরে যুক্ত করার মতো পরীক্ষামূলক অস্ত্রোপচার করা হতো। স্বভাবতই এসব অস্ত্রোপচার অসফল হলে মারা পড়তে হতো বন্দিদের।
ব্যারাকের বিল্ডিংয়ে ঢুকে শুরুতেই দেখলাম, কাচের ভেতর ‘জাইক্লোন বি’ নামের সেই রাসায়নিক, যার গ্যাসেই মেরে ফেলা হয়েছিল লাখ লাখ মানুষকে। রাসায়নিকের রং মূলত হালকা নীল, তবে কালের বিবর্তনে তা অনেকটাই ধূসরে পরিণত হয়েছে। পাশেই রাখা লাখ লাখ বন্দির চশমা। যেসব অসুস্থ বিকলাঙ্গ নারী-পুরুষ ধরে আনা হতো, তাদের কৃত্রিম পা, ধরে চলার লাঠি সব একস্থানে জড়ো করা। লাখ লাখ বন্দির পায়ের মলিন আর ছেঁড়াফাটা জুতা, শেভিং ব্রাশ, জুতার পালিশ। হাজারো তরুণীর চুল আঁচড়ানোর চিরুনি ...। দম বন্ধ করে এসব দেখতে দেখতে আমরা এক রুম থেকে আরেক রুমে যাচ্ছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। হয়তো বন্দিদের ব্যবহৃত এই জিনিসগুলো তাদের নিয়ে যাচ্ছিল বীভৎস সেইসব দিনে।
মৃত বেশ কয়েকটি শিশুর ছবি আর তাদের পরনের পোশাক দেখে কান্না আটকে রাখতে পারিনি আমি নিজেও।

এই পর্যায়ে গাইড আমাদের বলল, ‘এই বিল্ডিংয়ের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। আগে যা ছিল ঠিক সেভাবেই রাখা হয়েছে। যারা দুর্বল হৃদয়ের, তারা সাহস সঞ্চয় করো। আমরা এখন যাব গ্যাস চেম্বার আর ক্রিমেটেরিয়ামে, যেখানে সর্বোচ্চ ৭০০ বন্দিকে একসঙ্গে মেরে ফেলা সম্ভব।’
ভেবেছিলাম বেশ বড়সড় হবে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মোটামুটি ছোট্ট একটা জায়গায় কী ভয়াবহ উপায়ে বন্দিদের ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে জাইক্লোন বি গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হতো। গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আর এত মানুষের চাপে মুহূর্তেই মারা যেত বন্দিরা। দেয়ালে এখনো সেই পোড়া আর কালির দাগ স্পষ্ট! পাশেই লাশ পোড়ানোর ঘর। মৃত বন্দিদের একের পর এক নিয়ে ক্রিমেটেরিয়ামে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হতো। এত মানুষকে কবর দেওয়া সম্ভব না বলেই এই সাশ্রয়ী পদ্ধতি!!!
এসব দৃশ্য এতটাই ভয়াবহ যা আমরা কেউ কল্পনাও করিনি।
বের হয়ে আসার সময় দেখলাম, তিন স্তরের কাঁটাতারের বেড়া ক্যাম্পের পুরো প্রাচীরে, যার মাঝের স্তরে হাই ভোলটেজ কারেন্টের তার জড়ানো। কেউ পালাতে চাইলে হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক শকে যাতে সেখানেই তার মৃত্যু হয়, সে জন্য এই ব্যবস্থা। এ ছাড়া একটু পর পর ছিল ওয়াচ টাওয়ার, যেখানে পাহারা দিত জার্মান এসএস বাহিনী। মোটকথা এই ক্যাম্পে একবার প্রবেশের পর বন্দিদের পালানোর জন্য সামান্য কোনো পথও খোলা ছিল না।

একসময় অস্ট্রিয়ান আর পরে পোলিশ আর্মির ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত এই অশইউচ। যখন হিটলারের এসএস বাহিনী দখল করে, তখন এই এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০ জন, যাদের সবাইকে সরিয়ে ফেলা হয়। ১৯৪০ সালের মে মাসে প্রথম বন্দিদের দলটি এখানে এসে পৌঁছে। আর সবচেয়ে বড় চালানটি আসে একই বছর ১৪ জুনে। এর পর থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত চলে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বরফশীতল ঠান্ডায় মুক্তির আশায় কাজ করতে আসা, অপর্যাপ্ত কাপড়ে শীতে জমে যাওয়া সেইসব বন্দীরা মুক্তি পায়নি কখনোই।
হায় ইতিহাস! প্রাণের ইতিহাস যেমন সুন্দর, মৃত্যুর ইতিহাস ঠিক ততোটাই নির্মম, নিষ্ঠুর...।
সংবাদ উপস্থাপক ও বার্তাকক্ষ সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

শেখ ফাতেমা ওয়ারা