পূজার ছুটিতে
মেঘেদের খেলাঘর নীলগিরি
চারদিক ঘেরা সবুজ চাদরে ঢাকা পাহাড়ের সাম্রাজ্য, ওপরে মেঘহীন নীল আকাশ। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, নীল আকাশের বুক ছেড়ে শুভ্র মেঘগুলো গেল কোথায়। পরক্ষণেই আপনার প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন পাহাড়ের নিচের দিকে তাকিয়ে। অবাক হবেন এটা দেখে যে, আকাশের মেঘগুলো পাহাড়ের একটু নিচে মেঘের সাগর তৈরি করেছে। মেঘগুলো যেন তার সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে নিচের পৃথিবীটাকে ঢেকে দিয়েছে। ভাগ্য ভালো থাকলে মেঘগুলো একটু উপরে উঠে এসে ছুঁয়ে দিতে পারে আপনাকেও। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে মেঘেদের এমন দৃশ্যপট নিজের স্মৃতির ক্যামেরায় বন্দি করতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের অন্যতমও উঁচু পাহাড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার নীলগিরি থেকে।
নীলগিরি বান্দরবানের থানচি উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু পাহাড়। যাঁরা প্রায়ই প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে দেখার মতো এমন কী আছে যা একজন মানুষের মনকে হরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনার উচিত হবে বান্দরবানের নীলগিরি ঘুরে আসা। এর পর নিজেকে আবার এই প্রশ্ন করে দেখবেন, তখন আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তরটি পেয়ে যাবেন।
নীলগিরি তিন হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। নীলগিরির মোহিত করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই পর্যটক ছুটে আসেন প্রকৃতির এই সাম্রাজ্যে। নীলগিরিতে এসেই যা পর্যটকের মনকে আনন্দে নাচিয়ে তোলে তা হলো মেঘেদের খেলা। কখনো মনে হয় মেঘগুলো পাহাড়কে আলিঙ্গন করে মনের কথা বলছে, কখনো বা মনের আনন্দে ভেসে ভেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে। আকাশের পানে চেয়ে মেঘদের ছোটাছুটি আমরা সবাই দেখেছি; কিন্তু নিচে চেয়ে মেঘের এমন অপূর্ব খেলা কার না ভালো লাগবে। এমন মন হরণকারী দৃশ্য দেখে প্রকৃতিপ্রেমী মন গেয়ে উঠতে পারে, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ অথবা ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’র মতো সুন্দর গানগুলো।
কীভাবে যাবেন
নীলগিরি যেতে হলে আপনাকে বাসে করে যেতে হবে বান্দরবান সদরে। বান্দরবান সদর থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছে হিলবার্ড নামক স্থান থেকে আপনি নীলগিরি যাওয়ার চাঁদের গাড়ি নামে এক ধরনের গাড়ি পাবেন। অফ সিজন বা বিভিন্ন ছুটিকে কেন্দ্র করে চাঁদের গাড়ির ভাড়া কমবেশি হয়ে থাকে। যেমন ধরুন, কোনো ছুটি ছাড়া দিনগুলো বা অফ সিজনের সময় একটি চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে লাগতে পারে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে লাগতে পারে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। যদি কখনো একটানা বেশ কয়েক দিন সরকারি ছুটি থাকে, তখন একটি চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে লাগতে পারে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা। এ সময় প্রচুর পর্যটকের ভিড় থাকে। একটু আগেভাগেই চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে ফেলুন। মনে রাখবেন, কোনো দালাল দ্বারা গাড়ি ভাড়া না করে নিজে চাঁদের গাড়ির স্ট্যান্ডে গিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর দরদাম করে গাড়ি ভাড়া করাই উত্তম। তবে মনে রাখবেন, একটি চাঁদের গাড়িতে মোট ১৪ জনের বেশি লোক নেওয়া যাবে না। চাঁদের গাড়িতে চড়ে নীলগিরিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে দুই থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা।
পথে যা দেখবেন
নীলগিরিতে পৌঁছানোর আগেই যা আপনার প্রকৃতিপ্রেমী মনকে আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারে তা হলো বান্দরবনের উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা। বান্দরবান সদর থেকে নীলগিরি পর্যন্ত পুরো রাস্তাই পাহাড়ের ওপরে। কখনো খাড়া উঁচু, কখনো নিচু হয়ে, কখনো বা আঁকাবাঁকা হয়ে রাস্তা চলে গেছে নীলগিরির গন্তব্যে। এই রাস্তা একেবারেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে। কখনো রাস্তার ডান, কখনো বা বাঁ পাশে দেখতে পাবেন গভীর খাত। রাস্তা থেকে অনেক নিচে অবস্থিত ছোট পাহাড়, নদী কিংবা ছোট ছোট বাড়ি দেখে মন আনন্দে ভরে উঠতে পারে। পথে যেতে গাড়িতে বসেই মেঘের সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন, সে এক অন্য রকম ভালোলাগা। এ ছাড়া শৈলপ্রপাত বা চিম্বুক পাহাড়ের মতো দর্শনীয় স্থানগুলো পথেই পড়বে।
কখন যাবেন
বান্দরবানে সারা বছরই পর্যটকের আগমন ঘটে। তবে ভরা বর্ষার সময় সেখানে না যাওয়াই ভালো। কারণ, এ সময় পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকে। নীলগিরির আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে। এ ছাড়া শীতকালেও এখানে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে থাকে।
যা মনে রাখা প্রয়োজন
১. মনে রাখবেন বান্দরবানের রাস্তা খুবই উঁচু-নিচু এবং আঁকাবাঁকা। কিছু কিছু জায়গার মোড় রয়েছে। যেখানে অন্যপাশ থেকে কোনো গাড়ি আসছে কি না তা বোঝা মুশকিল, তবে এখানকার গাড়িচালকরা বেশ অভিজ্ঞ।
২. চলতি পথে মজা করতে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে চালককে অন্যমনস্ক করবেন না। এতে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
৩. পথে যেতে রাস্তায় আর্মি ক্যাম্পে আপনারা নাম ও ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন করে যেতে হবে।
৪. নীলগিরিতে বেশ কয়েকটি সুন্দর কটেজ ও বিশ্রাম নেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সেখানে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
৫. নীলগিরি ট্যুরিস্টদের জন্য নিরাপদ স্থান। এখানে আর্মি সারাক্ষণ তদারকিতে আছে। সুতরাং কোনো সমস্যা বা অনিয়ম দেখলে তাঁদের জানান।
৬. নীলগিরির ভিউ পয়েন্টগুলো বেশ সুন্দর। এখান থেকে নিচের দৃশ্য আপনার হৃদয়কে আনন্দে ভরিয়ে তুলবে। তবে সাবধান, ছবি বা সেলফি তুলতে গিয়ে কোনো বিপজ্জনক কাজ করবেন না।
৭. সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি, সানগ্লাস, ক্যাপ বা টুপি রাখুন।
৮. যাঁদের উঁচুতে উঠলে মাথাব্যথা হয়, তাঁরা সঙ্গে মাথাব্যথার ট্যাবলেট রাখুন।
৯. সকাল সকাল রওনা দিয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই হোটেলে ফেরত আসুন।
১০. নীলগিরির সুন্দর কটেজগুলোতে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাবেন।