৫০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক হাট ‘কালাইয়া’

বলা হয়, ‘যা দেয় হালাইয়া, তা পাওয়া যায় কালাইয়া’। ৫০০ বছরের এ পুরোনো বন্দরে পাওয়া যায় না এমন কোনো জিনিস নেই। সবই পাওয়া যায় এ বন্দরে। মধ্যযুগীয়, মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয়, পুর্তগীজ, ফিড়িঙ্গি এবং বার্মার বণিকরা এই হাটে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আসা যাওয়া করতেন। প্রাচীন ইতিহাস ধারক এই বন্দরটি পটুয়াখালীর কালাইয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। বর্তমানে এই হাটটিকে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক হাট বা বাণিজ্যিক বন্দর বলা হয়। কালাইয়া হাটের বর্তমান আয়তন ১০. ৫৪ একর। এ বন্দরে প্রতি সপ্তাহে সোমবার হাট বসে।
কালাইয়া বন্দরের গরু, মহিষ ও ধান হাটের জন্যও বিখ্যাত। দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী, ভোলা ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় থেকে এখানে গরু মহিষ বিক্রি করতে আসেন বেপারীরা। এসব গরু, মহিষ কিনতে চট্রগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা গরু মহিষ কিনতে আসেন।
ধানহাটে পটুয়াখালীর দশমিনা, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, ভোলার লালমোহন, চরফ্যাশন, বোরহানউদ্দিন ও দৌলতখান থেকে কৃষক ও ফড়িয়ারা ধান বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। এসব ধান স্থানীয় বড় বড় পাইকারের কিনে দেশের চালের জন্য বিখ্যাত এলাকায় বিক্রি করেন। এ বন্দরের মৎস্য বন্দরেরও সুখ্যাতি রয়েছে।

কালাইয়া বন্দরের সদর রোড, বাজার রোড, হেমায়েত মিয়ার মোড়, মার্চেন্ট পট্টি, কুমার পট্টি, কাপড় পট্রি, ধান হাট রোড, মাদ্রাসা রোড, হাইস্কুল রোড, প্যাদা রোড, সিনেমা হল রোড, কাচাবাজার রোড, চেয়ারম্যান সত্তার মাস্টার রোড, মোল্লা মার্কেট, কাটপট্রি ও আলী আকবর স্কুলের সামনের সড়কসহ বন্দরে প্রায় দুই হাজার স্থায়ী দোকান রয়েছে।
এ ছাড়াও হাটের দিন সোমবার বন্দরে পাঁচ শতাধিক ভাসমান দোকান বসে। একই হাটে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা ভীড় করেন। ইতিহাস ও ঐহিত্য জানতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরাও হাটে আসেন।
কালাইয়া বন্দরের ইতিহাস
১৩২০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল, ফরিদপুর ও খুলনার কিছু অংশ নিয়ে রাজা দনুজমর্দন দেব চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান ভোলা ও পটুয়াখালী জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রমত্তা তেঁতুলিয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের কচুয়া নামক স্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী। কচুয়ার পরির্বতে বাউফলের বাকলা নামটিও ইতিহাসসিদ্ধ। রাজা দনুজমর্দন দেবের শাসন আমলের পর পর্যায়ক্রমে তার পূত্র রমা বল্লভ, তার পূত্র কৃষ্ণ বল্লভ, হরি বল্লভ ও জয়দেব বল্লভ। জয়দেব বল্লভের কোনো পূত্র সন্তান ছিলেন না। কমলা দেবী ও বিদ্যসুন্দরী নামে দুই মেয়ে ছিল। তাদের মধ্যে কমলা ছিলেন প্রতিভাময়ী। পিতার নির্দেশে ১৪৯০ সালে কমলা দেবী চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাণী হয়ে সিংহাসনে আহোরণ করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, মধ্যযুগে রাজকুমারী কমলা দেবী ছিলেন একমাত্র ও শেষ নারী শাসক। রাজ্যের রানী হওয়ার পর সবাই তাকে কমলা রাণী বলে ডাকতেন। জনশ্রুতি রয়েছে, কমলা রাণীর কাছের লোক ছিলেন কালাই নামে এক ব্যক্তি। সে কচুয়ার অদুরে তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে বণিকদের নৌকা-গয়না রাখা ও প্রজাদের নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপত্র বেচা-কেনার জন্য স্থান ঠিক করে দেন এবং তার নামানুসারে এই বন্দরের নামকরণ হয় কালাইয়া বন্দর। কামলা রাণীর রাজ্যের প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য কালাইয়া বন্দরের পূর্বপাশে ২২০ জমির ওপর দিঘি খনন করে। যা কমলা রাণীর দিঘি নামে পরিচিত।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, বরিশালের বাবুগঞ্জের দেহেরগতি গ্রামের উষাপতির পূত্র বলভদ্র বসু ছিলেন কমলা রাণীর স্বামী। বলভদ্র বসু বিভিন্ন শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। বলভদ্র বসু কালো হওয়ায় প্রজারা তাকে কালা রাজা বা কালাই রাজা বলে ডাকতেন। এই কালারাজার নাম অনুসারেই কালাইয়া বন্দর নামকরণ করা হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। রাজা জয়দেব তার মেয়ে কমলা ও জামাতা বলভদ্র বসুর জন্য গলাচিপায় রাজপ্রসাদ নির্মাণ করে দেন। গলাচিপার কালারাজার বিল তার তার নামে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বন্দরের দর্শনীয় স্থানসমূহ
কালাইয়া বন্দরে রয়েছে ২৫০ বছরের পুরোনো পুকুর, যা বড় পুকুর নামে পরিচিত। বড় পুকুরের উত্তর পাড়ে রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো বড় জামে মসজিদ। পকুরের পশ্চিম পাড়ে পাশাপাশি হাজী জামে মসজিদ ও আখড়া বাড়ি মন্দির সম্প্রীতির বন্ধন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ও দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম গরু মহিষের হাট ও ধান হাট। শত বছরের পুরো লাল দালানের খাদ্য গুদাম। বন্দর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে দরবেশ তমির উদ্দিন আওলিয়ার মাজার। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে কালাইয়া লঞ্চঘাট থেকে পূর্বদিকে রয়েছে রাজা জয়দেব বল্লভের কন্যা ও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের শেষ রাণী কমলা রাণীর দিঘি।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে নৌপথে সহজে কালাইয়া বন্দরে যাওয়া যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদরঘাট থেকে কালাইয়ার উদ্দেশে প্রতিদিন লঞ্চ ছেড়ে আসেন। সকাল ৬ থেকে ৭টার মধ্যে লঞ্চ কালাইয়া ঘাটে পৌঁছায়। কালাইয়া লঞ্চঘাটও বন্দরের অংশ। ঢাকা থেকে সড়ক পথেও সরাসরি কালাইয়া যাওয়া যায়। ধোলাইপাড় ও সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে কালাইয়ার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে পদ্মাসেতু হয়ে এসব বাস কালাইয়া বন্দরে গিয়ে পৌঁছায়।
যেখানে থাকবেন ও খাবেন
বন্দরের বিভিন্ন বাংলা খাবার হোটেল রয়েছে। এসব হোটেল সুস্বাদু বাংলা খাবার পাওয়া যায়। চাইনিজ খাবারের হোটেলও রয়েছে। চাইলে কালাইয়া বন্দর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বাউফল উপজেলা শহর অথবা ৩৫ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে থাকা ও খাওয়ার উন্নত সুব্যবস্থা রয়েছে।