জনপদের গল্প
নিরানন্দ আনন্দবাজার

দুই দশক আগের কথা, গ্রামে দাদা-নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলেই চাচা-মামার কাছে বায়না থাকত, ‘সন্ধ্যার পরে বাজারে নিয়ে যেতে হবে’। কোথাও বেড়াতে গেলে সেই ঘরের কর্তার সঙ্গে সন্ধ্যায় বাজারে যাওয়ার খুনসুটি চলত। সন্ধ্যার বাজারে জিলাপি, মিষ্টি, দধির লোভে শিশুরা বাজারে যেতে চাইলেও, বয়োজ্যেষ্ঠরা যেতেন অন্য লোভে। কিছুটা বয়স বাড়ার পরে বুঝেছি– এই লোভ কীসের! আসলে দিনভর কাজ শেষে ক্লান্তি ভুলতে বয়োজ্যেষ্ঠরা বাজারে ছুটতেন। চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনায় অংশ নিতে বাজারে যেতেন। আবার মৌসুমি ও ওমর সানীর বাংলা সিনেমা দেখা কিংবা ক্যারাম খেলার লোভেও সন্ধ্যার পর বাজারে জমতেন গ্রামের তরুণ-যুবকরা। প্রতিদিন প্রান্তিক গ্রামের বাজারগুলোতে এমন সরল বাঙালিয়া ও সাবলীল জীবনচিত্র ফুটে উঠে। সেই চিরাচরিত দৃশ্য এখনও দেখা যাবে আনন্দবাজারে। তবে বর্তমানের আনন্দবাজার শুধুই আনন্দ ভাগাভাগির জন্য নয়, বিষাদ ভাগাভাগিও হয় অন্তরে অন্তরে, অশ্রুমূল্যে।
ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার অধীন একটি দ্বীপ ইউনিয়ন ‘ঢালচর’। ঢালচরের আয়তন পাঁচ হাজার ১৮২ একর। দ্বীপের তিন পাশে মেঘনা নদী। এক পাশে বঙ্গোপসাগর। ঢালচরের পশ্চিম-উত্তরে চর কুকরী মুকরী, পূর্বে নতুন ঢালচর। দক্ষিণ আইচা থানার আওতাধীন এ ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্র ‘আনন্দবাজার’। অর্থাৎ ঢালচরের কেন্দ্রীয় বাজারের নামই আনন্দবাজার।
জানা গেছে, মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত এই দ্বীপে বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। এই ডিজিটাল যুগেও এ দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যার পরে এ দ্বীপে কোনো কাজের সুযোগও নেই। তবে হ্যাজাক কিংবা জেনারেটরে আলোতে মিলনমেলা জমে বাজারে। তাইতো, সন্ধ্যা হতেই পুরো দ্বীপের মানুষ আস্তে আস্তে আসতে থাকে বাজারের পথে। দিনের বেলা যেখানে হাতেগোনা মানুষের চলাচল, সন্ধ্যার পরে সেই বাজারেই মানুষের মেলা বসে।

এ চরের পুরুষদের আনন্দের আশ্রয়স্থল এই বাজার। দিনভর পেশাগত ব্যস্ততার শেষে, সবাই সবার খোঁজ নিতে বাজারে জমায়েত হন। এরপর নানা প্রসঙ্গে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। সিঙ্গারা-রুটি-মিষ্টির পর পানের সঙ্গে গল্প জমে। শুধু গল্প কেন– কারো সাহায্য-প্রয়োজন-সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ, বিয়ের কথাবার্তা, সামাজিক-ধর্মীয় আয়োজন অনুষ্ঠিত হয় এই বাজারে। এ ছাড়াও ঢালচরের উন্নয়নে নেওয়া পরিকল্পনা, উদ্যোগ, আলোচনাগুলো অনুষ্ঠিত হয় সন্ধ্যার পরে, এই বাজারে। এক কথায়, দ্বীপের সামগ্রিক উন্নয়ন-উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দু আনন্দবাজার।
আনন্দবাজার ঢালচরবাসীর মেলবন্ধনের কেন্দ্রবিন্দুও। আন্তরিকতা, সামাজিকতা, আপ্যায়নে অভ্যস্ত সবাই! সবাই সবাইকে চা-পানের আপ্যায়ন করছে। সবাই সবার খোঁজ নিচ্ছে। দেখা যায়, কোনো কোনো অসুস্থ বৃদ্ধও লাঠিতে ভর দিতে দিতে চলে আসেন এই বাজারে। এরপর সবাই সেই বৃদ্ধের শরীরের খোঁজ নিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন, দোয়া করছেন, মানসিক সাহস যোগালেন। ফলে বাজার থেকে ঘরে ফেরার পথেই সেই অসুস্থ মানুষটিও সুস্থ হওয়ার শক্তি ফিরে পাচ্ছেন।
স্থানীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তিও এই বাজারটি। অনেকেই দিনভর কাজের মজুরি বুঝে নেয় সন্ধ্যার পরে বাজারে এসে। এখানে এনজিও কর্মকর্তা কিস্তি ওঠান সন্ধ্যার পরে, গ্রাহক বাজারে এলে। মসজিদ-মাদরাসার দানের টাকা ওঠাতে দেখা যাবে। মালিক-শ্রমিকের শ্রম বিক্রির চুক্তি, একত্রিত হয়ে মাছ ধরার চুক্তি, আড়তদার বনাম জেলে চুক্তি, মাছের জন্য দাদন নামক লেনদেনও হয় বাজারে বসে সন্ধ্যার পরে। শ্রেণিতে শ্রেণিতে লেনদেন চলে। অল্প অল্প টাকার এসব চুক্তির শেষে মিষ্টি, পুরি কিংবা পরোটার আপ্যায়ন চলে।
তবে দিনভর বিশ্রামে থেকে সন্ধ্যার পরে এখানে ব্যস্ত হয়ে ওঠে দোকানিরা। চায়ের দোকানে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা। কেটলিতে পানি ফুটতে থাকে, চা বানানো, কাপগুলো ধুয়ে ফের ফের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিক্রেতা। মুচির দোকান, সেলুন, দেশীয় ফলের দোকান ও ফার্মেসিগুলোতেও ব্যস্ততার চিত্র। বাজার থেকে ফেরার সময়, ঘরের প্রয়োজনীয় সদায়টুকুও কিনে নিচ্ছেন অনেকেই। ফলে মুদির দোকান, মাছের দোকান, মুরগির দোকানগুলোও সরব। মাছ ধরার জালের দোকানেও ভালো কেনা-বেচা চলে। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরার বয়া, দড়ি, সুতা, ভাষা, ফ্লুটও বিক্রি হয় এসব দোকানে। বেশ জমজমাট ভিড় থাকে এই দোকানগুলোতে। কারণ এ দ্বীপের অধিকাংশ জেলে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারের সবার পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি-জামা। কারও মধ্যে সাহেবি চলাচল নেই। কোনো বিবাদ কলহও নেই। দরদাম চলে, ক্রয়-বিক্রয় চলে। এভাবেই প্রাণে প্রাণে চলে আনন্দ-অনুভূতির ভাগাভাগি। তবে এরই মধ্যে বিষাদের বার্তাও এসেছে। ভাঙনের আতঙ্ক এই আগেকার আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে।
জানা গেছে, ঢালচরে এই বাজার চালুর আগে যে বাজারটি ছিল, তাও নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। ২০০০ সালের দিকে আনন্দবাজার চালু হয়। তখন বাজারের জন্য নতুন জায়গা নির্বাচনের পরই মানুষের মনে নতুন করে আনন্দ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই আনন্দের কারণেই এই বাজারের নামকরণ করা হয়েছিল আনন্দবাজার। তৎকালীন চেয়ারম্যান, স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকসহ গণ্যমান্যরা মিলে এই নাম ঠিক করেছিলেন বলে জানা যায়। এরপর চলে যায় ২৫ বছর।
ভাঙন রেখা বাজারের খুব কাছাকাছি। মানুষের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা আনন্দবাজার প্রকৃতির বিচারে হয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে। দ্বীপের বাসিন্দারা বলছে, এই বাজার হয়তো আর কয়েক মাস কিংবা বছরের ব্যবধানে ভেঙে যাবে। ২৫ বছরের স্মৃতিময় বাজার, এই যে মেলবন্ধন, এই যে পেশাগত আয়োজন, এসব নতুন অভ্যস্ততায় রচিত হবে।
ঢালচরের মানুষের প্রয়োজনে নতুন বাজার বানানো হচ্ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের উদ্যোগে বানানো নতুন বাজারটির নাম রাখা হয়েছে ‘চেয়ারম্যান বাজার’। তবে, নতুন বাজার কী পুরানো গণ্ডির ভালোবাসার মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে পারবে? এতো এতো স্মৃতিরা কী সেখানে নতুন করে ঠাঁই পাবে? এসব প্রশ্ন দ্বীপবাসীর মনে বারবার সুঁই ফোটায়। স্মৃতি আর ভাবনাগুলো ঢালচরবাসীকে কাঁদায়। বারবার তাদের স্মরণ করতে হয়, নদী ভাঙন ভিটে-মাটি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিগুলোও ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।