ভ্রমণের নেশায় আলেকজান্ডার মেঘনাপাড়
আঁকাবাঁকা বেড়িবাঁধের পথ। সামনে বিশাল নদী। ঢেউ খেলে। নৌকা নাচে। মুক্ত আকাশের নিচে, ঢেউয়ের তালে তালে নৌকার ছোটাছুটি বুঝিয়ে দেয়, মৎস্যজীবীরা ইলিশ ধরেন। ওদিকে ভোরের আঁধার পেরিয়ে সূর্য মামা উঁকি দেয়, পড়ন্ত বিকেলে নদীর স্বচ্ছ জলে আলো বিছিয়ে নিজের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখাতেও ভোলেন না সূর্য মামা। মাঝেমধ্যে রাতের আঁধারে আলো ছড়ায় চাঁদ মামা। সমুখে বিশাল নদী আর মুক্ত আকাশের প্রাণছোঁয়া বাতাসের সান্নিধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের পা পড়ে আলেকজান্ডার মেঘনার পাড়ে। যেখানে প্রতি মুহূর্ত থাকে মুখর, মিলনমেলা হয় প্রকৃতিপ্রেমীদের।
আলেকজান্ডার মেঘনাতীর উপকূলবর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার আধুনিক শহর আলেকজান্ডার বাজারের একটু অদূরেই অবস্থিত। আলেকজান্ডার শহরকে ঘিরেই মেঘনার তীর ঘেঁষে এ বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। মূলত মেঘনার ভাঙনে যখন এ অঞ্চলের মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এ সাড়ে তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। কিন্তু ভাঙন ঠেকানোর বেড়িবাঁধ যে পর্যটন এলাকায় পরিণত হবে, সে কথা কেউ আগে ভাবেনি। নদীভাঙনে আক্রান্ত এ জেলার মানুষের সেরা একটি দর্শনীয় স্থানের জায়গা দখল করে নেয় আলেকজান্ডার মেঘনাতীর।
ঈদ-উৎসবে আলেকজান্ডার মেঘনাপাড়ে যেন তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। ঘুরে আসা মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে এ নদীতীর। দর্শনার্থীদের ভ্রমণকে আরো উপভোগ্য করতে রাখা হয়েছে স্পিডবোটের ব্যবস্থা। কেউ চাইলেই অল্প খরচে কিছুক্ষণের জন্য নদীর মোহনায় স্পিডবোটে করে ঘুরতে পারে। আলেকজান্ডার মেঘনার পাড় থেকে দক্ষিণে চোখ রাখলে তেমন কোনো জনপদের চিহ্নও চোখে পড়ে না। দক্ষিণে নদী গিয়ে সোজা মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। যে কারণে এখানকার প্রকৃতির রূপটাও বেশ। তবে আলেকজান্ডার মেঘনার পাড় থেকে ট্রলার যোগে এক ঘণ্টা দক্ষিণ-পশ্চিমে চললে দেখা মিলবে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা চর গজরিয়ার। ভ্রমণপিয়াসু অনেকে ঘুরতে এসে এ চরটিতেও ঘুরতে যান।
আলেকজান্ডার মেঘনাতীরকে স্থানীয়রা আলেকজান্ডার মেঘনা বিচ বলে। এ বিচের পূর্ব প্রান্তে একটি ভিন্ন দৃশ্য দেখা যায়। যেখানে নদী, সেখানে বেড়িবাঁধ। আর এ দুইয়ের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে আলেকজান্ডার টু নোয়াখালীর সোনাপুর সড়ক। এ যেন কক্সবাজার সৈকতের পাড়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কের দৃশ্য। নদীর স্বচ্ছ জল, আকাশের নীলাভ দৃশ্য, সড়ক, বেড়িবাঁধ। সব যেন মিলেমিশে একাকার। সড়কপথে ছুটে চলা কেউ চাইলেই মুহূর্তের মধ্যে বেড়িবাঁধে উঠে নদীতীরের নয়নাভিরাম প্রকৃতি উপভোগ করতে পারে। মন চাইলে মুঠোফোনের ক্যামেরা অপশন চালু করে কয়েকটা সেলফি তুলেও গন্তব্যে ফেরা যায়।
আলেকজান্ডার নদীতীরের এমন মন মাতানো দৃশ্যকে পর্যটকদের কাছে আরো আর্কষণীয় করে তুলতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের বেশি কিছু উদ্যোগও প্রশংসনীয়। বেড়িবাঁধের পথ ধরে হাঁটলে নজরে পড়বে ছাতার মতো আশ্রয়শালা, বেড়িবাঁধের পাশে লাগানো ঝাউ গাছ, ল্যামপোস্টের বাতি। তা ছাড়া পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের নজরদারিও রয়েছে। নদীতীরে যখন রাতের আঁধার নামে, তখন ল্যাম্টপোস্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠলে যেন আরেক দারুণ দৃশ্যের দেখা মেলে। এ দৃশ্য আরো চমৎকার হয়ে ওঠে, যখন আকাশের ঠিকানায় চাঁদ মামা আলো ছড়ায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত সব সময়ই দর্শনার্থীদের মিলনস্থল আলেকজান্ডার মেঘনাতীর।
আলেকজান্ডার মেঘনাপাড় এখন কেবল লক্ষ্মীপুর জেলার মানুষের ভ্রমণপিপাসা মেটানোর জায়গা নয়। লক্ষ্মীপুর ছাড়াও পাশের জেলা নোয়াখালী এবং ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুরের মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে আলেকজান্ডার নদীতীর।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সতর্কতা
আলেকজান্ডার মেঘনাতীর যেহেতু একটি বেড়িবাঁধ, সেজন্য আপনাকে অবশ্যই বেশ সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হবে। বেড়িবাঁধ যেহেতু অনেকটা ঢালু পথ, সোজা নয়। সে জন্য অবশ্য বেড়িবাঁধ দিয়ে হাঁটতে অনেক সতর্কতার প্রয়োজন। তবে উপরের অংশে সমতল পথ আছে। সেখান দিয়ে হাঁটতে পারবেন। আর বেড়িবাঁধের ওপর থেকে নিচে নামতে এবং নিচ থেকে ওপরে উঠতে সাবধানতাও অবলম্বন করা জরুরি। আর আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখবেন, কোনোভাবেই যেন আপনার দ্বারা বেড়িবাঁধ এলাকা অপরিষ্কার না হয়।
কোথায় থাকবেন?
চর আলেকজান্ডারে এখনো থাকার মতো কোনো আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেনি। রাত্রিযাপন করতে হবে জেলা শহরে। জেলা শহরে উন্নত মানের বেশ কিছু গেস্ট হাউজ গড়ে উঠেছে। উন্নত মানের আবাসিক হোটেলও রয়েছে। বাগবাড়িস্থ ঐতিহ্য কনভেশন ও স্টার গেস্ট হাউজ এবং চক বাজারস্থ সোনার বাংলা আবাসিক রেস্টুরেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা হাউস অন্যতম। সেক্ষেত্রে আপনার খরচ আসবে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
কোথায় খাবেন?
সকাল বা রাতের খাবারটা গেস্ট হাউজেই সেরে নিতে পারবেন। দিনের বেলায় যেহেতু ভ্রমণে আসবেন, সেহেতু আলেকজান্ডার বাজার অথবা মেঘনাতীরে তাজা ইলিশ ভোজনে দুপুরের খাবারও খেয়ে নিতে পারবেন। আর মহিষের খাঁটি দধির স্বাদটাও নিতে ভুলবেন না। চাইলে নদীতীরের ঘাট থেকে ইলিশ আর হোটেল বা দধির দোকান থেকে দধি নিয়ে আসতে পারবেন। ইলিশ যেমন তাজা, দধিও তেমন খাঁটি। ইলিশ আর দধি লক্ষ্মীপুর জেলার ঐতিহ্য।
যেভাবে যাবেন আলেকজান্ডার মেঘনাতীর
রাজধানী ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সড়কপথে বাসে করে কিংবা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে চাঁদপুর হয়ে জেলার শহরের ঝুমুর স্টেশন, তারপর লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের যেকোনো গাড়িতে আলেকজান্ডার নেমে সেখান থেকে উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে মেঘনাপাড়ে পৌঁছানো যাবে। তবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি সানফ্লাওয়ার বা হিমাচল আলেকজান্ডার যায়। লঞ্চে গেলে খরচ পড়বে আসা-যাওয়া মোট ৮৮০ টাকা, আর সড়কপথে বাসে করে গেলে মোট আসা-যাওয়ার খরচ পড়বে এক হাজার ৪০ টাকা।