অপহরণের পর শিশুহত্যা, নেপথ্যে দুই স্কুলছাত্রের গেমিং ল্যাপটপের লোভ!
কান্না থামছে না গৃহবধূ সামসুন্নাহারের। ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে আদরের সন্তানকে হারিয়ে বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। অপহরণকারীরা বিশেষ আইপি নম্বর ব্যবহার করে দাবি করেছিল টাকা। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণের টাকার জন্যে দেওয়া একটি বিকাশ নম্বরের সূত্রে আসামিরা ধরা পড়ার পরও চোখ কপালে উঠেছে গোয়েন্দাদের।
পিলে চমকানার মতোই ঘটনা। জড়িত দুজনই নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা একে অপরের বন্ধু। এদের একজন মোবাইল ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে শিখেছিল অন্যকে ফোন করে নিজের নম্বর গোপন করার কৌশল। সে কৌশল কাজে লাগিয়ে গেমিং ল্যাপটপ কেনার জন্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তারা অপহরণের পর খুন করে শিশু ইয়ামিনকে।
তারপর সন্দেহের তালিকা থেকে বাঁচতে নিজেরাই মিশে যায় সন্তান হারানো পরিবারের সঙ্গে। এমনকি নিখোঁজের সন্ধান চেয়ে মাইকিংয়েও অংশ নেয় দুজন। পেশাদার অপরাধীদের মতো নিখুঁতভাবে শিশু অপহরণ। তারপর অচেনা নম্বর ব্যবহার করে মুক্তিপণ দাবি। শেষে শিশুটিকে হত্যা করে লাশ গুম। দুই স্কুল শিক্ষার্থীর ছকে গড়া এমন নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে খোদ গোয়েন্দাদের।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে সামান্য একটি গেমিং ল্যাপটপ কেনার জন্যে অর্থ সংগ্রহে অপহরণ করা হয় মালয়েশিয়া প্রবাসীর আট বছর বয়সি সন্তান ইয়ামিনকে।
ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান জানান, গত নভেম্বর নিজের বাসা থেকে নিখোঁজ হয় নরসিংদীর রায়পুরা উত্তর বাখরনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়ামিন। সে প্রবাসী জামাল উদ্দিন ও সামসুন্নাহার বেগম দম্পত্তির সন্তান।
ইয়ামিনের মা সামসুন্নাহার বেগম জানান, ২৮ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে ছেলে ইয়ামিনকে বাড়িতে রেখে স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে ভোট দিতে যান তিনি। বেলা ১২টার দিকে বাড়ি ফিরে সন্তানকে না পেয়ে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। তাও না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। এর মধ্যে অচেনা নম্বর (আইপি নম্বর) থেকে ফোনে দাবি করা হয় মুক্তিপণ।
ঘটনার তিন দিন পর সামসুন্নাহার বেগম বাদী হয়ে মামলা করেন নরসিংদীর রায়পুরা থানায়। এর মধ্যেই চলতে থাকে মুঠোফোনে মুক্তিপণ দাবি।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে আসা মাত্রই অপহরণের ঘটনাটির ছায়া তদন্তের দায়িত্ব দেই জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে।’
বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে আইপি অ্যাড্রেসের মাধ্যমে আসা ফোন কল থেকে কিছুতেই অপহরণকারীদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারছিলেন না গোয়েন্দারা।
কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ‘এর মধ্যে বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে পঁচা লাশের গন্ধের সূত্রে পাওয়া যায় শিশু ইয়ামিনের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। অপহৃত শিশুকে জীবিত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা হারিয়ে যায়। আদরের সন্তানকে হারিয়ে পাগলপারা হয়ে যান মা। জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের বিষয়টি হয়ে পড়ে চ্যালেঞ্জের।’
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাসার বলেন, ‘তদন্তের শুরুতে আমরা সন্দেহভাজনদের প্রতি নিবিড় নজরদারি শুরু করি। কিন্তু, মোবাইলে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করে ভিপিএনের মাধ্যমে কলগুলো আসায় সেসব নম্বর ভিন্ন দেশের হওয়ায় অপরাধীদের শনাক্ত করা ছিল বেশ দুরূহ কাজ। তদন্তের শুরু থেকে প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম স্যার। এরই মধ্যে তড়িঘড়ি করে জড়িতেরা ভিপিএন নম্বর থেকে মুক্তিপণ টাকা পাঠানোর জন্যে একটি বিকাশ নম্বর দিলে আমরা ক্লু পেয়ে যাই। যদিও সে নম্বরটি আদতে বিকাশ নম্বর হিসেবে নিবন্ধিত ছিল না এবং ফোনটি যার নামে নিবন্ধিত তিনি সেটি ব্যবহার করছিলেন না।’
আবুল বাসার জানান, একপর্যায়ে গতকাল শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) রাতে রায়পুরা থানার উত্তর বাখরনগর এলাকা থেকে সিয়াম উদ্দিনকে (১৭) এবং রায়পুরা থানাধীন পিরিজকান্দি এলাকা থেকে রাসেল মিয়াকে (১৮) আটক করার পর জট খুলে যায় তদন্তের। আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত স্কচটেপ ও বালিশ এবং অপহরণ ঘটনায় ব্যবহৃত মোবাইল ও সিম। তাদের অত্র মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
এদের মধ্যে উত্তর বাখরনগর গ্রামের সিয়াম উদ্দিন স্থানীয় ইম্পেরিয়াল মডেল হাই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর, পিরিজকান্দি গ্রামের রাসেল মিয়া তার স্কুল জীবনের সহপাঠী।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ল্যাপটপ কিনে ইউটিউবে গেম লোড করে টাকা উপার্জনের জন্য মালয়েশিয়া প্রবাসী জামাল উদ্দিনের সন্তান ইয়ামিনকে অপহরণ ও মুক্তিপণের পরিকল্পনা করে তারা। পরিকল্পনা অনুসারে শিশুটিকে খেলার ছলে প্রতিবেশী সিয়ামের বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে মুখ, হাত, পা বেঁধে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর বস্তায় ভরে ডোবায় ফেলে দেয়। পরে তার মায়ের কাছে অ্যাপ ব্যবহার করে ভিপিএনের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
পুলিশের সামনে একেবারেই শান্ত স্বাভাবিকভাবে সিয়াম বলে, ‘আমরা টেলিভিশন আর ইউটিউবে ভারতীয় সিআইডি ক্রাইম পেট্রোল দেখে দেখে পরিকল্পনা করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে আমরা বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে ফোন করেছি। যাকে ফোন করেছি তার নম্বরে অচেনা নম্বর ভেসে ওঠায় আমাদের শনাক্ত করা কঠিন ছিল।’
এ ঘটনায় সহযোগী হিসেবে সুজন মিয়া (২৪) এবং কাঞ্চন মিয়া (৫৪) নামের আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আবুল বাসারের নেতৃত্বে ডিবির এসআই মোহাম্মদ তানভীর মোর্শেদ, এসআই কবির উদ্দিন, এসআই মো. সফিউদ্দিন ও রায়পুরা থানা পুলিশের এসআই জহিরুল হকের টিম অল্প সময়ের ব্যবধানে এ ঘটনা উদঘাটনের মাধ্যমে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। তবে, আমাদের চিন্তা অন্য জায়গায়। এ দুই কিশোরের এমন অপরাধ সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের কিশোর তরুণেরা কীভাবে বেড়ে উঠছে—সে প্রশ্নটাই চলে আসে সবার সামনে।’