আদালতেও জঙ্গিদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ
আলোচিত রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা মামলার রায়ের সময়ও জঙ্গিদের আচরণ ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ; মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় শোনার পরও তাদের চোখেমুখে কোনো আতঙ্ক তো ছিলই না, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে তারা আদালতে দাঁড়িয়েই আইনজীবীদের হত্যার হুমকি দিয়েছে, স্লোগান দিয়ে পরিবেশকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেছে।
আজ বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ের আদেশের সময় আট আসামিই আদালতে উপস্থিত ছিল। আদালতে উপস্থিত ব্যক্তিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে আসামিদের আচরণের দিকটি।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিরা হলো—রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, মো. আবদুস সবুর খান, মো. আসলাম হোসেন র্যাশ, মো. হাদিসুর রহমান সাগর, মো.শরিফুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন। পাশাপাশি তাদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। রায়ে খালাস পাওয়া একমাত্র আসামি হলো মো. মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান।
রায় ঘোষণার আগে সব আসামিকে একটি প্রিজনভ্যানে করে আদালত চত্বরে নিয়ে আসা হয়। তাদের যখন গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছিল সবাই ছিল স্বাভাবিক, কারো কারো মুখে হাসিও ছিল। কেউ কেউ আঙুল তুলে ইঙ্গিত করছিল। মামলার রায় নিয়ে আসামিদের মধ্যে কোনো প্রকার আতঙ্ক বা চাপ ছিল না।
এজলাসে বিচারক আসেন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটের দিকে। তার দু-তিন মিনিট আগে আট আসামিকে একে একে কাঠগড়ায় তোলা হয়। এই সময় আসামিরা আদালত কক্ষের দিকে চেয়ে চুপচাপ ছিল।
বিচারক এজলাসে বসলে আসামিরাও সেদিকে দৃষ্টি দেয়। বিচারক রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করলে আসামিরাও রায় শোনার জন্য নীরবে অপেক্ষা করতে থাকেন। তখন গোটা কক্ষেই পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যেই বিচারক রায় পড়া শেষ করেন। প্রথমে রায়ের পর্যবেক্ষণ পড়েন, পরে পড়েন সাজার অংশটুকু। রায় পড়া শেষ করেই বিচারক খাস কামলায় চলে যান।
রায় ঘোষণার পরই মুহূর্তের মধ্যেই আদালত কক্ষের পরিবেশ পাল্টে যায়। প্রথমেই চিৎকার দিয়ে ওঠেন মো. মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। তিনি বিশেষ ধ্বনিও দেন। তিনি ভেবেছিলেন, তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পরে যখন জানল মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে; তখন সে চুপ হয়ে যায়। পরে অন্য আসামিরাও চিৎকার ও স্লোগান দেওয়া শুরু করে। দফায় দফায় স্লোগান, ধ্বনি ও চিৎকারে জঙ্গিরা আদালত কক্ষ সরগরম করে তোলে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আসামিদের ঘিরে সতর্ক অবস্থায় ছিল।
এরপর আসামি রফিবুল ইসলাম রিগ্যান কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রায় মেনে না নেওয়ার কথা বলে চিৎকার করতে থাকে। সে বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো বিচারকের রায় মানি না।’ এ সময় সে স্লোগানের সঙ্গেও তাল মেলায়। বেপরোয়া দেখাচ্ছিল তাকে।
জঙ্গি মো. আবদুস সবুর খান স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে গালাগালও করছিল। কাঠগড়ায় তাকে সবচেয়ে বেশি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে দেখা গেছে। তিনি একটানা স্লোগান ও গালি দিতে থাকলে একজন আইনজীবী তাকে থামতে বলেন। কিন্তু সেই আইনজীবীকে প্রকাশ্যেই হত্যার হুমকি দিতে দেখা যায় সবুর খানকে।
তবে অন্য সবার থেকে আলাদা ছিল জঙ্গি হাদিসুর রহমান সাগর। তার আচরণ ছিল অন্যদের বিপরীত। সে কাঁদছিল। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি ১৬৪ ধারা দিই নাই, আমি নির্দোষ। পুলিশ জোর করে পিটিয়ে আমার সামনের একটি দাঁত ভেঙে ফেলেছে। আমি এ বিষয়টি বিচারকের খাস কামরায়ও বলেছিলাম। আমার কাছ থেকে জোর করে জবানবন্দি আদায় করেছে, এগুলো আমার না। আমি ন্যায়বিচার চাই।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এরপর একে একে সব আসামিকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে পাঁচতলা আদালত ভবনের বাইরে বের করে নিয়ে আসেন এবং প্রিজনভ্যানে তোলেন। প্রিজনভ্যানে উঠানোর সময়ও জঙ্গিরা ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে নানা কথা বলে চিৎকার ও স্লোগান দিচ্ছিলেন।
এরপর একপর্যায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাতজন ও খালাসপ্রাপ্ত একজনকে নিয়ে কারাগারের দিকে রওনা হয় প্রিজনভ্যান।
আদালত এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাংলাদেশে ‘জিহাদ কায়েমের লক্ষ্য’, ‘জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা’ এবং মাধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ‘দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই’ জঙ্গিরা রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পরিকল্পনা করে। রায়ে হামলার ‘মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়কারী’ হিসেবে আদালত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরীর কথা উল্লেখ করেছেন।
চাঞ্চল্যকর এ মামলায় সরকারপক্ষে শুনানি করেন গোলাম ছারওয়ার খান জাকির। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন।
মামলার শুনানি শেষে গত ১৭ নভেম্বর মামলার রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন আদালত। গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলাটির বিচার শুরু হয়েছিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে।
এর আগে গত বছরের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে আটজন আসামি ঘটনার পর বিভিন্ন অভিযানে এবং পাঁচজন হলি আর্টিজানে অভিযানের সময় নিহত হয়। বাকি আট আসামির উপস্থিতিতে আজ রায় ঘোষণা করা হয়।
হলি আর্টিজান অভিযানে নিহত ৫ জঙ্গি
হলি আর্টিজানে হামলা পরবর্তী অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়েছিল। তারা হলো রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
বিভিন্ন অভিযানে নিহত ৮
হলি আর্টিজানর মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মধ্যে বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত আটজন হলো তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
গুলশান হামলা নিহত হয়েছিলেন যাঁরা
হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা গুলি করে ও গলা কেটে বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করেন। তাঁরা হলেন ইতালীয় নাগরিক ফেডো ট্রেডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিসেস ক্লাওদিয়া মারিয়া ডি এন্তোনা (৫৬), মিসেস সিমোনা মন্টি (৩৪), স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিসেস নাদিয়া বেনেডেট্টি (৫১) ও সুপারভাইজার মার্কো টোনডাট (৪১), একটি টেক্সটাইল গ্রুপের মাননিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপক মিসেস আদেলে পুগলিসি (৫৫), ক্রিশ্চিয়ান রসি (৪৭), একটি টেক্সটাইল কোম্পানির মালিক ক্লাদিও ক্যাপেলি (৪৫), মিসেস ভিনসেনজো ডি অ্যালেস্ট্রো (৪৫) ও মিসেস মারিয়া রিবোলি (৩৩)।
নিহত জাপানি নাগরিকরা হলেন মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষা কাজে নিয়োজিত হিরোশি তানাকা (৮০), কোয়ো ওগাসাওয়ারা (৫৭), ইয়োকি সাকাই (৪২), নোবুহিরো কোরুসাকি (৪৯), মাকোটো ওকামুরা (৩২), রুই সিমোডাইরা (২৯) ও হিডেকি হাশিমোটো (৬৫)।
ভারতীয় নাগরিক ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ছাত্রী তারিশি জৈন (১৮)।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক রাজধানীর গুলশান ২-এর ৫০ নম্বর রোডের বাসিন্দা মো. এহসানুল কবিরের মেয়ে অবিন্তা কবির (২০) এবং ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন (২০) নিহত হন।
অন্যদিকে ঘটনার শুরুতে জঙ্গিদের বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান ও ঢাকা মহানগর (উত্তরের) গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম।
অভিযানের সময় নিহত হন হলি আর্টিজান বেকারির দুই স্টাফ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কুলকাঠি গ্রামের হাসেম চৌকিদারের ছেলে সাইফুল চৌকিদার (৪০) ও নারায়ণগঞ্জ সদর থানার একরামপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার সরকারের ছেলে জাকির হোসেন শাওন (২২)।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। হামলার পর রাতেই তারা ২০ জনকে হত্যা করে। সেদিনই উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন পাঁচ হামলাকারী। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে। সংগঠনটির মুখপত্র ‘আমাক’ হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে বলে জানায় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ দাবি করে, নব্য জেএমবির সদস্যরা এই হামলা চালিয়েছে।
এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে দুই দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে, এ মামলায় কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি এ মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক