বিএমডিসির সনদ ছাড়াই ‘এমবিবিএস ডাক্তার’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কলারোয়াজুড়ে
এক সময় খুলনার একটি ক্লিনিকে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। দীর্ঘদিন সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলায় রোগী দেখা শুরু করেন। দীর্ঘদিন শুধু রোগীই দেখেন না, করেন আল্ট্রাসনোগ্রামের মতো কঠিন পরীক্ষাও। বিএমডিসির সনদ ছাড়াই নামের সঙ্গে এমবিবিএস (সনোলজিস্ট), এমন নানা চটকদার ডিগ্রির পরিচয়জুড়ে দিয়ে করারোয়াজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শাহরিয়ার আহমেদ।
মাতৃসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি প্যাডে তার এমন নানা ডিগ্রিযুক্ত ব্যবস্থাপত্র দেখা যায়। এ ছাড়া কলারোয়ার একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক পরিচয়ে নিয়মিত রোগী দেখেন ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করান। স্থানীয় বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। শাহরিয়ার আহমেদের জন্ম যশোরের নওয়াপাড়ায়।
বিষয়টি নিয়ে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সচেতন মহল থেকে গত ১০ নভেম্বর জেলার সিভিল সার্জনের বরাবর অভিযোগ জানান। অভিযোগে চিকিৎসক পরিচয় দেওয়া শাহরিয়ার আহমেদের এমবিবিএস সনদসহ আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর মতো প্রয়োজনীয় সনদ নেই বলে দাবি করা হয়।
অভিযোগ পাওয়ার পর সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আ. সালাম বিষয়টি কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শফিকুল ইসলামকে অবহিত করেন। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি নির্দেশ দেন বলে এ প্রতিবেদককে সিভিল সার্জন জানান।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. মো. আ. সালাম বলেন, আমি অভিযোগ পেয়েছি এবং তাৎক্ষণিক কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত শাহরিয়ার আহমেদকে তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ দেখা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু শাহরিয়ার দেখা করেননি। এ ভুয়া ডাক্তারের রোগী দেখার কোনো এখতিয়ার নেই। এটা অপরাধ।
অনুলিপি পাননি ওসি
সিভিল সার্জনের মতামতের প্রেক্ষিতে কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শফিকুল ইসলাম গত ১১ নভেম্বর একটি চিঠি লেখেন কলারোয়ার বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সভাপতি বরাবর। ওই চিঠিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক, সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন, কলারোয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বরাবর অনুলিপি পাঠানোর কথা।
তবে, অনুলিপি পাওয়ার কথা অস্বীকার করে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি অনুলিপি পাইনি। পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।
সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ
এ ঘটনা জানাজানি হলে এলাকার মানুষের মধ্যে শাহরিয়ার আহমেদকে নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু ভুয়া ডাক্তার না, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে মানুষেরা গলা কাটা হয়। বিভিন্ন চিকিৎসক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লেখেন। এই ওষুধ লেখার জন্য তারা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা ও বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেন। এগুলো সবাই জানেন, কিন্তু কেউ কথা বলেন না।
কলারোয়ার নাজমুল হুদা নামের এক ব্যক্তি বলেন, সবকিছু জানার পরও প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যদি চুপ থাকেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? ভুয়া ডাক্তার দেখার দায়িত্ব সাধারণ মানুষের না। এগুলো দেখবে প্রশাসন। সাধারণ মানুষের ওই শক্তি নেই। তাহলে তারা যাবে কোথায়?
শরিফ উদ্দিন নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আমার স্ত্রী-সন্তান সব সময় কলারোয়াতে চিকিৎসা করায়। এ ঘটনা শোনার পর থেকে আমি ভয় পাচ্ছি। এরপর আর কলারোয়ায় ডাক্তার দেখাব না। কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী যখন গর্ভবতী ছিল, তখন এক ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে একই ধরনের দুই গ্রুপের মেডিসিন লেখেন। পরে আমি আরেক ডাক্তারকে সেই প্রেসক্রিপশন দেখাই। তিনি একই ধরনের দুই মেডিসিন খেতে নিষেধ করেন। এখন ডাক্তার যদি এভাবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে লেখাপড়া না জানা লোকের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, আমরা কোথায় যাব? এটা সেবামূলক পেশা। এখানে ব্যবসা করলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে? বেশি বেশি ওষুধ দিয়ে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে টাকা নেন ডাক্তারা।
আইন কী বলে?
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন (২০১০) এর ৬১ নম্বর আইনের ২৮ ধারায় প্রতারণামূলক প্রতিনিধিত্ব বা নিবন্ধনের দণ্ডের উপধারা ১ নম্বর অংশে বলা হয়েছে, “যদি কোন ব্যক্তি প্রতারণার আশ্রয় লইয়া ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে একজন স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসক বা স্বীকৃত ডেন্টাল চিকিৎসক হিসাবে এই আইনের অধীনে নিবন্ধন অথবা নিবন্ধন করিবার উদ্যোগ গ্রহণ, অথবা মিথ্যা বা প্রতারণামূলক প্রতিনিধিত্ব প্রকাশ করিবার চেষ্টা করেন অথবা মৌখিক বা লিখিতভাবে উক্তরূপ ঘোষণা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।”
আইনে আরও বলা হয়েছে, “উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ সংঘটনে সহায়তাকারী ব্যক্তি উক্ত উপ-ধারায় উল্লিখিত দণ্ডে সমানভাবে দণ্ডনীয় হইবেন। এই আইনের অধীন নিবন্ধনকৃত না হইয়াও যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে এই আইনের অধীনে নিবন্ধনকৃত একজন মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক বলিয়া প্রতারণা করেন, অথবা প্রতারণামূলকভাবে তাহার নাম বা পদবীর সংগে নিবন্ধনকৃত মর্মে কোন শব্দ, বর্ণ বা অভিব্যক্তি ব্যবহার করেন, তাহার মিথ্যা পরিচয়ের দ্বারা অন্য কোন ব্যক্তি প্রতারিত না হইলেও, তাহার উক্ত কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ড বা ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।”
ডা. মো. শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, তিনি কলারোয়ার সব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে তিনি জানান, “উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের আলোকে অবগত করানো যাইতেছে যে, জনাব শাহরিয়ার আহমেদের বিএমডি এর সনদ না থাকা সত্ত্বেও তাকে দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়ার বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রামসহ রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করানো হয়। যা বিএমডিসি আইনের পরিপন্থি। এমতাবস্থায় জনাব শাহরিয়ার আহমেদ এর মাধ্যমে বেসরকারি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আল্ট্রাসনোগ্রাম ও চিকিৎসা সেবা না করানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হইল।”
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা এ চিঠি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দিয়েছি। কোন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর ব্যত্যয় করলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব।
অভিযোগ রয়েছে শাহরিয়ার এ চিঠি জারির পরেও বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাতায়াত করছেন। গতকাল শুক্রবারও তিনি দুজন রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করিয়েছেন।
কলারোয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে জড়িত একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শাহরিয়ার অনেকদিন ধরে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন, রোগী দেখেন। তার খুব দাপট। চিঠি জারির পরও শাহরিয়ার বলছেন, তার কিছু হবে না। এ কথা তিনি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকদের বলে বেড়াচ্ছেন।
চিঠি ইস্যু হওয়ার পরও ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শাহরিয়ার রোগী দেখেছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে ডা. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে তাকে কেউ জানায়নি। সঠিক তথ্য দিয়ে জানালে আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স নিয়ে শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট করব। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অবগত রয়েছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। আপনারা যে কোন মুহূর্তে খবর পাবেন শাহরিয়ারকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
শাহরিয়ার আহমেদ চিকিৎসক পরিচয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কোনো ভুক্তভোগী যদি অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিভিল সার্জনের কাছে অভিযোগকারী ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে জানান, আমি চাই তদন্ত করে ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করা হোক।
অভিযোগকারী ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে বলেন, যেখানে সিভিল সার্জন ভুয়া ডাক্তার শাহরিয়ারের ব্যাপারে জানেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানেন, থানার ওসিও জানেন। তাহলে আমার প্রশ্ন, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? আইন তো তাকে অপরাধী বলছে। তিনি কি আইনের ঊর্ধ্বে? নাকি তিনি কোনো অপক্ষমতা ব্যবহার করে গ্রেপ্তার এড়াচ্ছেন?
অভিযোগকারী সিভিল সার্জনের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, সেখানে তিনি লিখেছেন, কলারোয়া হাসপাতাল রোডের হাসান ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডক্টরস ল্যাব, নোভা ডিজিটাল, স্টার প্যাথলজি, ই-ল্যাব, সুরক্ষা ডায়াগনস্টিক, শেফা ডায়াগনস্টিক, মুন্না ডায়াগনস্টিক, মিতালি ডায়াগনস্টিক, মাতৃসেবা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কলারোয়া শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে শাহরিয়ার চেম্বার ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন। কলারোয়াতে অনেক এমবিবিএস ডাক্তার থাকার পরেও বেশি টাকা আয় করার জন্য সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিককরা বিএমডিসি রেজিস্টার্ড না এমন ভুয়া ডাক্তার দিয়ে রোগী দেখা ও আলট্রাসনোগ্রাম করাচ্ছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য শাহরিয়ার আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হয়। তবে, মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ফখরুল ইসলাম (শাহীন)