উপকূলে আজও দগদগে ১৯৭০-এর ক্ষত
আজ ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আঘাত হানে শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। সে আঘাতে হাজারও মানুষের প্রাণহানি হয়। সেদিন মানুষের মৃত্যুর মিছিলে কেঁদেছিল সারা বিশ্ব। প্রাণ হারায় অগনিত গৃহপালিত পশু ও বন্য প্রাণী। দুমড়ে-মুচড়ে যায় গাছপালা ও ঘরবাড়ি। নষ্ট হয় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। সে বন্যায় বেঁচে ফেরা মানুষগুলোর জীবন থেকে কেটে গেছে ৫১ বছর। যাঁরা তখন কিশোর বা তরুণ ছিলেন, তাঁরা এখন বৃদ্ধ। মনের মধ্যে দগদগে সে দিনটিকে আজও বয়ে বেড়ায় উপকূলে বসবাসরত সেসব মানুষ।
১৯৭০-এর ভোলা সাইক্লোনে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রানহানি ঘটে। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উপকূল বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদন সূত্র বলছে, ঝড়টি সিম্পসন স্কেল ক্যাটাগরিতে তিন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। যা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রেকর্ড করা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। সূত্র বলছে, ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয়। ক্রমে শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বাধিক গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে ঝড়টি। জলোচ্ছাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার এক লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূলের বহু এলাকা মানবশূন্য জনপদে পরিণত হয়। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, স্বন্দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, চর কুকরি- মুকরি, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখান, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ। ধ্বংস হয় মাছের ঘের, ফসল, রাস্তা, কালভার্ট, বাড়িঘর, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
সেই থেকে এ দিনটি উপকূলবাসীর জন্য স্মরণীয় দিন। দিনটি ভুলতে পারেননি, সেদিন যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন। সন্তানহারা মা আজও কাঁদেন। ঘুম হারিয়েছে সেসব বোন, যাদের চোখের সামনে জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়েছিল ভাইকে।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় উলানিয়া গ্রামের বাসিন্দা হামিদ মিয়া। ১৯৭০ এ তাঁর ঠিকানা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন। কথা হয়, প্রত্যক্ষদর্শী হামিদ মিয়ার সঙ্গে। কথা বলার একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন হামিদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘নিজের ভাইয়ের লাশটা সেদিন খুঁজে পাইনি, তয় শত শত লাশ মাটি চাপা দিছি হেই বোইন্যায়। কত মানুষ যে পাগলের মতো তাগোর আপনজনরে খোঁজ্জে (খুঁজেছে) হেই দৃশ্য বইলা বুঝানো যাইবো না। মনে হইছে যেন কোনো কেয়ামতের মাঠ।’
এখনও অরক্ষিত উপকূল। উপকূলীয় মানুষের জীবনধারার উন্নয়ন, সংকটের উত্তরণ এবং সম্ভাবনাময় উপকূলকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশিদার করে তোলা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে উপকূলীয় জীবনযাত্রা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ প্রভাব ফেলছে আমাদের জলবায়ুতে। এসব প্রতিরোধে সমগ্র বিশ্বের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
দিনটিকে কেন্দ্র করে সমগ্র উপকূলে দাবি উঠেছে, ১২ নভেম্বরকে সরকারিভাবে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণার। উপকূল সন্ধানী সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর নির্দেশনায় এ বছরও উপকূলের নানা স্থানে পালিত হচ্ছে উপকূল দিবস। বেসরকারি উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পালিত হচ্ছে দিবসটি।
এত দিবসের ভিড়ে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস প্রসঙ্গে উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, ‘উপকূলের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয় না। উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়াতে এবং উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটাতে উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাব করা হয়েছে।’
উপকূল দিবসের যথার্থতা প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম মন্টু আরও জানান, ‘উপকূল দিবস’হিসেবে এমন একটা দিন উপকূলবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন সবাই মিলে একযোগে বলবে উপকূল উন্নয়নের কথা। তাছাড়া অক্টোবর-নভেম্বরের মৌসুমে বাংলাদেশের উপকূলে আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এসব বিবেচনায় ১২ নভেম্বর হোক ‘উপকূল দিবস’।
প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’ উপকূলবাসীর জন্য শোকের দিন হিসেবে পরিচিত। ১২ নভেম্বর দিনটির ইতিহাস আজও কাঁদায় উপকূলের মানুষকে। সেদিনের ক্ষত আজও দগদগে অসখ্য মানুষের জীবনে। ভয়াল সেসব ছবি এখনও চোখ ভাসিয়ে দেয় চিরতরে স্বজন হারা হাজারো মানুষের।