গ্যাস সংকটে নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের উৎপাদন ব্যাহত
ভয়াবহ গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লার কাঠেরপোল, বিসিক শিল্পনগরীসহ জেলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। গ্যাস সংকটের কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গার্মেন্টস শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গ্যাস না পাওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্পকারখানা। বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য দিতে পারছেন না অনেক রপ্তানিকারক। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারকে দ্রুত গ্যাস সংকট নিরসনে তাগিদ দিয়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।
শিল্পাঞ্চলগুলোতে সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে আড়াইহাজার সাওঘাট, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, ফতুল্লার কাঠেরপোল, বিসিক শিল্পনগরী ও জেলার শিল্প কারখানায় ভয়াবহ গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গত চার মাসে গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ৪০টির অধিক শিল্প কারখানা। যারা কারখানা চালু রাখছেন, তাদেরও চালাতে হচ্ছে ধুঁকে ধুঁকে। কাপড় ডাইং করতে গেলে গ্যাস মিলছে না। যেখানে ১০ পিএসআই গ্যাসের প্রেসার থাকার কথা, সেখানে নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। গ্যাস সংকটে উৎপাদন বন্ধ থাকায় অলস সময় পার করছেন শ্রমিকরা।
ফতুল্লার কাঠেরপোল এলাকায় অবস্থিত আজাদ রিফাত ফাইবার্স প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রাজীব জানান, গ্যাস সংকটের এমন দুরবস্থায় গ্যাস বিল দেওয়া হচ্ছে কিন্তু গ্যাস লাইনে পাওয়া যাচ্ছে বাতাস। গ্যাস সংকটে সময় মতো বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডারকৃত পণ্য না দিতে পারায় অনেক অর্ডার বন্ধের পথে। আবার গ্যাসের বিলও অনেক বাড়ানো হয়েছে।
পঞ্চবটির বিসিক শিল্পনগরীর ক্রোনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএইচ এম আসলাম সানী জানান, আড়াই বছর ধরে গ্যাস সংকটে ভুগছি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের পরে অর্থনৈতিক যে মন্দা, সেই মন্দায় প্রত্যেকটি বায়ার ৩০ শতাংশ আরএমজি কম দিচ্ছে, ডিমান্ড কমে গেছে মার্কেটে। ডিমান্ড কমে যাওয়ায় আমরা কিছু কিছু অর্ডার পাচ্ছি। আবার টিকে থাকার জন্য অর্ডারগুলো এক্সিকিউট করতে পারছি না, গ্যাস সংকটের কারণে। গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর পর ব্যবসায়ীদের নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়া হবে বলে সরকার জানিয়েছিল, কিন্তু সেটা বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে।
ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কাশেম জানান, আমরা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়েছি কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে ডায়িং করতে পারছি না। গ্যাসের প্রেসার নেই। যখন থাকে তখন এত কম থাকে আমরা জেনারেটর চালাতে পারি না। একদিনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি সময়ই জেনারেটর বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাস না থাকার কারণে। বয়লার বন্ধ। কাপড় ডাইং মেশিনে উঠানো হলেও কন্টিনিউ প্রসেস না হলে গ্যাস ফল্ট করলে তখন ফেব্রিক্স এর সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার দ্বিতীয়বার ডাইং করতে দুই গুণ সময় লাগে। তাতে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা এটা বোঝে না। বিদেশি ক্রেতারা বলেন, গ্যাস সংকট এটা তোমাদের সমস্যা, আমাদের তাতে কী। তোমরা অর্ডার নিয়েছ সময় মতো অর্ডার শিপমেন্ট করবা।
ফেয়ার অ্যাপারেলস লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হাসান জানান, গ্যাস সংকটের কারণে যেমন বিদেশি ক্রেতাদের নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে। সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিপমেন্ট করতে হয়। গ্যাস সংকটের কারণে দুই-তিন দিন শিপমেন্ট পিছানো কিংবা উৎপাদন দেরি হচ্ছে সেটা বিদেশি ক্রেতারা বুঝতে চায় না। একদিকে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে শ্রমিকরা অলস সময় পার করছে। তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতিম এনটিভি অনলাইনকে জানান, বাংলাদেশে অনেক অর্ডার কমে গেছে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু গ্যাস সংকটে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত ও রপ্তানি সংকুচিত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস না পেয়েও গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এনটিভি অনলাইনকে জানান, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অর্ডার সারা বিশ্বে কমে গেছে। সময় মতো শিপমেন্ট করতে না পারলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার ক্যানসেল করে দেয়। গত ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে গ্যাসের মূল্য অনেক বাড়ানো হয়েছে। সারা বিশ্বে তেল ও গ্যাসের মূল্য কমে আসছে। তারপরেও সরকার দাম সমন্বয় করার জন্য দাম বাড়িয়েছে। আমাদেরকে বলা হয়েছিল নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সাপ্লাই দেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছি না। গ্যাস সংকটের কারণে ফ্যাক্টরিগুলোর প্রোডাকশন অনেক কমে গেছে। একদিকে অর্ডার কম অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকদের বেতন বাড়ছে, আগামীতে আরও বাড়বে। এই ক্ষেত্রে আমরা যদি গ্যাস না পাই তাহলে আমরা বায়ারদের সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছি না। ইতোমধ্যে এই মাসের এপ্রিল থেকে গত বছরের এপ্রিল থেকে ১৬ শতাংশ অর্ডার কমে গেছে। মে মাসে অর্ডার আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ যেখানে ২০২১ এর আগস্ট মাসে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের উপরে ছিল, সেটা নেমে ৩০ বিলিয়ন ডলারে চলে এসেছে। সুতরাং এক্সপোর্ট যদি আমরা ধরে রাখতে না পারি তাহলে ফরেন কারেন্সির ওপরে আরও চাপ পড়বে।
নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস না পাওয়া গেলে নতুন শিল্প উদ্যোক্তারা যেমন মুখ ফিরিয়ে নেবে তেমনি শিল্প কারখানা বন্ধ হলে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাবে।
এ ব্যাপারে এনটিভির ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কেউই।