দেশে বেড়েছে অপপ্রচার, কমেছে হ্যাকিং : গবেষণা
দেশে সাইবার অপরাধের শিকার ৫০ শতাংশের বেশি ভুক্তভোগী নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। যদিও গত বছরের তুলনায় কমেছে অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, আর বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা ২০২২’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয় হয়েছে।
জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি। এবারের জরিপে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে, যা গতবারের প্রতিবেদনে ছিল ৫০ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এবার দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় চার দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে, চিন্তার বিষয় এই যে, গতবারের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু, এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় দুই দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।
এ ছাড়া যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ গতবার সাত দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল, সেটা এবার বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে পাঁচ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও এবার বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক ৯৩ শতাংশ।
করোনা মহামারির কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে গেছে। জরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৫ দশমিক ছয় শতাংশ মানুষ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এই গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সাইবার প্যারাডাইজ লিমিটেড। সিসিএ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মনিরা নাজমী জাহান।
মনিরা নাজমী জাহান বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রপ্রচার বাড়ছে। সাইবার অপরাধের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। ১৮ থেকে ৩০ বয়সী ভুক্তভোগীর হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। লোকলজ্জার ভয়ে হয়রানির শিকার ৭৩ দশমিক চার শতাংশই আইনের আশ্রয় নিচ্ছে না। এ ছাড়া আইনের আশ্রয় নেওয়া ভুক্তভোগীদের মাত্র সাত দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ আইনি সেবার প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’
জরিপে ২০২১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২-এর ২ মার্চ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগী ১৯৯ জনকে ১৮টি প্রশ্ন করা হয়। সেই মতামতের ভিত্তিতে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
আলোচকদের মধ্যে ছিলেন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির পরিচালক সাকিফ আহমেদ, সাবেক অডিটর জেনারেল ও প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সুলতানা ইশরাত জাহান।
কাজী মুস্তাফিজ বলেন, ‘গবেষণায় সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ভুক্তভোগীরা মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত ছিলেন। তাঁরা কোথাও প্রতিকার না পেয়ে সিসিএ ফাউন্ডেশনের কাছে সহায়তা চান। কিন্তু, ভার্চুয়াল জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে আর বেশি কিছু করার থাকে না।’
সাকিফ আহমেদ বলেন, ‘দেশে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার অবৈধ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীদের লগ সংরক্ষণ করে না, এটি জরুরি।’
ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘বর্তমানে গুজবও একটা মারাত্মক বিষয়। আন্তর্জাতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রকাশিত সংবাদের ৮০ শতাংশ অসত্য। এজন্য সচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকেও আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’
এডিসি সুলতানা ইশরাত জাহান বলেন, ‘অনেকে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েও অভিযোগ করে না। কিন্তু, পুলিশ প্রশাসনকে আইন মেনেই কাজ করতে হয়। তাই আইনি প্রতিকারের বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং অপরাধের শিকার হলে দ্রুত নিকটস্থ থানায় অথবা সিআইডি অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। তাহলে আইনি প্রতিকার মিলবে।’
ভুক্তভোগীদের বয়স
ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর এবং এই হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগী এবং এই ভুক্তভোগীদের হার ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৩১-৪৫ বছর বয়সের ভুক্তভোগী যাদের হার পাঁচ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সর্বশেষ অবস্থান করছে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের ভুক্তভোগী, যার হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। ১৮-৩০ বছর এবং ১৮ এর চেয়ে কম বয়সের ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি হ্যাকিং বা তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন বেশি। আরেকটি আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগীদের বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় চার দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি এসেছে এবারের জরিপে।
জেন্ডারভিত্তিক অপরাধ
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারী ও পুরুষের মধ্য সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হয়েছেন। সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডারভিত্তিক পার্থক্য করলে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্য পুরষের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ২২ শতাংশ এবং নারীদের সংখ্যা ৫৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।