পরচুলার কাজে সংসারের অভাব ঘোচাচ্ছেন সৈয়দপুরের নারীরা
‘স্বামী শ্রমজীবী। পাঁচজনের সংসার হামার। যে কামাই করে সেই দিয়ে টানাটানি হয়। ভালোমন্দ খাবার পাই না। ছয় মাস থাকি এইঠে চুলের কাম করিছি, আড়াই হাজার টাকা করি পাই। সংসারোত দিবার পারিছি। কষ্টও কম হয়ছে। এই জাগাত খালি চুল বাচি দিবার নাগে। ৬০-৭০ জনের মতো কাজ করি হামরা।’
বলছিলেন নীলফামারীর সৈয়দুপর উপজেলার কাশীরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের হাজারিহাট এলাকার জিন্নাতুন নেহা (৩৮)।
এখানে কাজ করেন আরেক মধ্যবয়স্ক নারী বুলবুলি বেগম(৫৫)। স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। ছেলের সংসারে থাকেন। সংসারে রয়েছে অভাব অনটন। নিজের হাত খরচ যোগাতে দলবদ্ধ হয়ে তিনিও এখানে কাজ করছেন চুলের।
বুলবুলি বেগম বলেন, ছেলের সংসারে খেয়ে দিন চলে। নানা অভাব অনটন রয়েছে। নিজের অনেক খরচ আছে। সেগুলোতো আর ছেলে দেয় না। প্রতিবেশির বাড়িতে চুলের কাজ হচ্ছে ছয় মাস থেকে। এখানে ঢুকে কাজ করছি। নিজের প্রয়োজনের টাকাটা তো পাচ্ছি।
শুধু জান্নাতি কিংবা বুলবুলি নয়, কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের পালপাড়া, সিপাহিটারী ও চৌপথি এলাকা ঘুরলে দেখা যাবে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যস্ততা।
সকাল হলেই ফ্যাক্টরিতে দলবেঁধে যাওয়া আর বিকেল হলে দলবেঁধে বাড়ি যাওয়ার চিত্র চোখে পড়বে এলাকার সড়কগুলোতে। কেউ চুল বাছাই, কেউ আবার প্রক্রিয়াজাত করছেন এসব ফ্যাক্টরিতে।
দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন উঠাচ্ছেন পরচুলা উৎপাদনের কাজ করে।
কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের চৌপথি এলাকার সাগরিকা আকতার। বাড়ির পাশে ছোট একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন ছয় মাস ধরে। মাসে ছয় হাজার টাকা করে পাচ্ছেন।
সাগরিকা আকতার বলেন, বাড়ির পাশাপাশি ফ্যাক্টরি। হেঁটে যাতায়াত করতে পারছি। বাড়ির কাজও করা যাচ্ছে। এই এলাকার অনেক মহিলা আমার মতো উপার্জনমূলক কাজে নিয়জিত। স্বামীর উপার্জনে সহযোগিতা করতে পারছি। অনেক উপকার হয়েছে আমাদের। একজনের টাকায় সংসার চালানো কঠিন এখন।
এলাকার মর্জিনা বেগমের বাড়িতে গড়ে উঠেছে ছোট ফাক্টরি। তিনি নিজেও ফ্যাক্টরিতে সময় দেন। বাড়ি ভাড়া বাবদ পাঁচ হাজার এবং ফ্যাক্টরি দেখাশোনা বাবদ পান তিন হাজার টাকা। আট হাজার টাকা দিয়ে সংসারে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
মর্জিনা বেগম জানান, স্বামী মতিয়ার রহমান শারীরিক প্রতিবন্ধী। রিকশা চালান। অভাব অনটন রয়েছে পরিবারে। সংসার খরচ মেটানোর পাশাপাশি বড় মেয়ে রংপুরে নার্সিংয়ে পড়ে। তার খরচ চালাই আমার টাকা দিয়ে। এখন ভালো চলছে আমাদের। এই এলাকার অনেক নারীর এখন আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে এই কাজ করে।
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের সাত- আট হাজার নারী উৎপাদনমুখী নানান কর্মকাণ্ডে জড়িত। এর ফলে এলাকায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সংসারে অনেক স্বচ্ছলতা এসেছে। এলাকার প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ। দিন আনে দিন খায়।
নারীরা ফ্যাক্টরিগুলোতে কাজ করে স্বামীকে যেমন সহায়তা করছেন, তেমন নিজের হাতের খরচও মেটাতে পারছেন।
উদ্যোক্তা মুকুল মিয়া জানান, আমার কয়েকটি ফ্যাক্টরিতে প্রায় দুই হাজার মহিলা কাজ করেন। সাব-কন্টান্ট নিয়ে পরচুলা উৎপাদন করছি। যাদের কাছ থেকে আমরা অর্ডার নিয়েছি, তারা এগুলো ঢাকায় পাঠায়। যারা কাজ করেন তারা সবাই নারী। দশ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন উঠাতে পারেন তারা। এর ফলে এলাকার একটা জনগোষ্ঠীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
মুকুল মিয়া বলেন, শুধু আমি নই, আমার মতো আরও তিন চারজন সাব-কন্টাক্টে এই কাজ করাচ্ছেন। এলাকার সাত-আট হাজার নারী এর ফলে কাজ পেয়েছেন। তাদের সংসারে পরিবর্তন এসেছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ প্রশংসার দাবিদার উল্লেখ করে নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি ফরহানুল হক বলেন, নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেড হওয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদনমুখী অনেক ফ্যাক্টরি হয়েছে এই এলাকায়। এর ফলে শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে। নারীরা কাজ পেয়েছে। যে নারীরা বাড়ির কাজ শেষে বসে থাকতেন, ওই সময়টুকু এখন নানা কাজে শ্রম দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
নারীদের কাজের সুযোগ তৈরিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের জন্য চেম্বার পাশে থাকবে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক হুসনে আরা বেগম বলেন, কেউ আর এখন শুধু গৃহিণী থাকতে চান না। গ্রামে ঘুরলে দেখা যাবে, নারীদের ক্ষুদ্র নানান কাজে অংশগ্রহণের চিত্র। নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ফলে অর্থনীতির চাকা মজবুত হচ্ছে এই অঞ্চলের। ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন নারীরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘নারীদের মধ্য থেকে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তারা কর্মক্ষেত্র তৈরি করছেন। এর ফলে নারীরা যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে তেমনি সংসারে সক্ষমতা বাড়ছে। গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশে বিসিক নারীদের নানাভাবে পাশে রয়েছে ও সহযোগিতা করছে।’