ফিরে দেখা ২০২১ : বছরজুড়ে আলোচনায় যত অপরাধ
সময় গড়িয়ে আরেকটি বছরের অবসান হলো। আসছে নতুন বছর। এ বছরজুড়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে কিছু ঘটনা ছিল চাঞ্চল্যকর এবং স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো। এসব ঘটনা জন্ম দিয়েছিল আলোচনা-সমালোচনা ও ঘৃণার, চারদিকে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল, আন্দোলন-বিক্ষোভসহ গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। তেমনই কয়েকটি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো।
কলাবাগানে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও মৃত্যু
বছরের শুরুটা হয়েছিল এক ন্যাক্কারজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। এ দিন রাজধানীর কলাবাগান এলাকার একটি স্কুলের ‘ও’ লেভেলের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় হত্যাকারীর বিচার চেয়ে সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। দাবি করা হয়—রাজধানীর কলাবাগানের নিজের বাসায় ওই শিক্ষার্থীকে ‘ফুঁসলিয়ে’ ডেকে নিয়ে বর্বরোচিত ও পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করে তার বন্ধু ফারদিন ইফতেখার দিহান। এ ঘটনায় ছাত্রীর বাবা একটি হত্যা মামলা করেন কলাবাগান থানায়। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয় দিহান।
এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)। গত ৮ নভেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিটটি দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক খালেদ সাইফুল্লাহ।
চার্জশিটে খালেদ সাইফুল্লাহ উল্লেখ করেন, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হওয়ার একমাত্র কারণ—আসামি দিহান তাকে ফুসলিয়ে তার নির্জন বাসায় এনে ধর্ষণ করেন। এতে গোপনাঙ্গে রক্তক্ষরণে ভুক্তভোগী অচেতন হয়ে পড়ে।
কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যু
২৫ ফেব্রুয়ারি। এ দিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাবন্দি লেখক মুশতাক আহমেদের গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর পর নানামুখী প্রশ্ন দেখা দেয়। মৃত্যুর দুদিন আগে (২৩ ফেব্রুয়ারি) তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে হাজির করলে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে তাঁর স্বজনদের সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাৎ শেষে মুশতাকের স্বজনেরা জানিয়েছিলেন, মুশতাক সুস্থ আছেন। কিন্তু, তারপর কী এমন হয়েছিল যে, তাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এমন প্রশ্নের মধ্যেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সড়কে নামেন, বিক্ষোভ করেন। লেখক মুশতাককে হত্যা করা হয়েছে দাবি তুলে এর বিচারের দাবিও জানান। কিন্তু, এসব কর্মসূচি ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
যদিও কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, মুশতাক আহমেদ অসুস্থবোধ করলে তাঁকে গাজীপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি মারা যান। গত বছরের মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা একটি মামলায় মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ আরও তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে কিশোর ও মুশতাক ছাড়া অন্য দুজন জামিনে মুক্ত হন। কয়েক দফা জামিন চাইলেও কিশোর ও মুশতাকের জামিন মেলেনি।
নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর, বিক্ষোভ
গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসেন। তিনি ঢাকায় আসার আগেই ২৩ মার্চ তাঁর ঢাকা সফরের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল প্রগতিশীল ছাত্রজোটের কয়েকটি বাম দলের ছাত্র সংগঠন।
এ বিক্ষোভের ঘটনায় দুপক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে আহত হয় অন্তত ২০-২৫ জন। সংঘর্ষের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়—দুপক্ষই পাল্টাপাল্টি ধাওয়া দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন—সরকারি দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এ হামলা চালিয়েছে। ছাত্রলীগ অবশ্য বলেছিল, তারা এ ঘটনা সম্পর্কে জানে না।
এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দল যুব অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে দুপক্ষেরই কয়েকজন আহত হয়। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।
শ্রকিদের বিক্ষোভ, পুলিশের গুলিতে নিহত পাঁচ
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় একটি বেসরকারি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বাড়ানো, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালুসহ ১২ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন সেখানে কর্মরত শ্রমিকেরা। যদিও এ আন্দোলন দীর্ঘদিনের। এতে যোগ দেন গ্রামবাসী। এ বিক্ষোভে পুলিশ বাধা দেয়।
শ্রমিক-গ্রামবাসী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে পাঁচ জন নিহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশের মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। যদিও এ ব্যাপারে পুলিশ গণমাধ্যমে দাবি করেছিল—কিছু উত্তেজিত শ্রমিক সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ করতে শুরু করেন এবং যানবাহনে ভাঙচুর চালায়, অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে, তাঁদের চারপাশ থেকে ঘেরাও করে ফেলে। চারপাশ থেকে ইটপাটকেল মারা হচ্ছিল। তাঁদের সামনে-পেছনে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। পরে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ড, নিহত ৫২
যে কয়েকটি ঘটনা মানুষের মনে নাড়া দিয়েছিল, তার মধ্যে গত ৮ জুলাই সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল অন্যতম। ওই রাতে আগুনে পোড়া মোট ৫২টি লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এদের মধ্যে ৪৮ জনকে ওই রাতেই ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে স্বজনদের আহাজারি আর চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠেছিল সেখানকার পরিবেশ।
ওই রাত থেকেই নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ঢামেকে এসে উপস্থিত হয়। বেশ কিছু লাশ চেনার উপায় ছিল না। পুড়ে কয়লা হয়েছিল। সেগুলোর জন্য স্বজনদের ডিএনএ’র নমুনা নিয়ে লাশ শনাক্তের কাজ করে সংশ্লিষ্টরা। এসব লাশ ফিরে পেতে পরিবারের লোকজন ছবি নিয়ে ঘুরছিলেন। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠেছিল ঢামেক মর্গের পরিবেশ।
শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলন
গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনায় নাঈম হাসান নামের নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার গাড়ি নাঈমকে চাপা দেয়। তারপর থেকে শিক্ষার্থীরা নাঈম হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর অন্যত্র।
একে একে রাজধানীর অনেক সড়কে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। মুহূর্তেই এ আন্দোলন হয়ে ওঠে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার দাবিও। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মধ্যেই গত ২৯ নভেম্বর রাতে রামপুরায় বাসচাপায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. মাঈনুদ্দিন নিহত হন। এরপর থেকে প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীরা লাল কার্ড প্রদর্শন করেন। করেন ব্যঙ্গচিত্র প্রদশর্নও।
পূজামণ্ডপে কোরআন, সারা দেশে মণ্ডপ ও বাড়িঘরে হামলা
কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দীঘির পাড়ে একটি পূজামণ্ডপে প্রতিমার কোলে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন শরিফ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা ঘটে গত ১৩ অক্টোবর ভোরে। তারপর এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে শহরের বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছিলেন সেখানকার পূজা উদ্যাপন কমিটির সম্পাদক নির্মল পাল।
কিন্তু, ঘটনা সেখানেই থেমে যায়নি। এ উত্তেজনার রেশ চলতে থাকে। ওই দিনই কুমিল্লা শহরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধদের সংঘর্ষ হয়। ঘটনা আরও উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। পরে এ ঘটনার জেরে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বেশ কয়েকটি মন্দিরে হামলা এবং পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চাঁদপুরে চার জন ব্যক্তি নিহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়।
এ ছাড়া নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের পেকুয়াসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশ তদন্ত করতে থাকে, আর এসব ঘটনা যেন বাড়তেই থাকে। নানা সময়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে ও মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটলেও সাম্প্রতিককালে এত বড় হামলার ঘটনা চোখে পড়ে না।
এরই ধারাবাহিকতায় ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে রংপুরের সদর উপজেলার পাগলাপীর ঠাকুরপাড়া গ্রামের হিন্দু ধর্মালম্বীদের ঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট হয়। বেশ কিছু ঘরে আগুন দিয়ে সেখানে থাকা গরু-ছাগলসহ তাদের সব মালামাল লুট করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষ হয়। এবং একজন নিহত হন।
আগুন শুধু লঞ্চ নয়, পুড়িয়েছে অনেক স্বপ্ন
পানি দিয়েই সাধারণত আগুন নেভানো হয়। কিন্তু, বছরের শেষ দিকে এসে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এম ভি অভিযান-১০ লঞ্চে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। গত ২৪ ডিসেম্বর ভোরে ঘটা এ ঘটনায় গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে শতাধিক যাত্রী। তবে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কত জন নিখোঁজ রয়েছে, তা জানা যায়নি। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম।
এ ঘটনায় মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি হার মেনেছে বীভৎস আগুনের কাছে। অনেক স্বপ্ন আর সম্ভাবনা আগুনের উত্তাপে দলা পাকিয়ে গেছে। অকল্পনীয়, বীভৎস, করুণ এ মৃত্যু। আগুনের লেলিহান শিখা শুধু লঞ্চটিকেই পুড়িয়ে দেয়নি, ভস্ম করেছে অনেক স্বপ্ন। মুহূর্তেই সন্তান হারিয়েছে তার মা, মা হারিয়েছেন সন্তান। শত শত মানুষের কান্নায় বিষখালী নদীর তীর ভারী হয়ে উঠে। নিখোঁজ স্বজনকে ফিরে পেতে ছবি হাতে এখনও আহাজারি করছে পরিবারের সদস্যেরা।