বরিশালে অন্যরকম ভালোবাসা ও বিয়ের গল্প
ছোটবেলা থেকেই পরিচয়, তবে প্রেমের সম্পর্ক বছর পাঁচেকের। যাঁর সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়লেন, শিশুকালে তাঁর দুহাতই এক বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সব কিছু জেনে-শুনেই প্রেমের সম্পর্কে জড়ান পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা সদরের বাসিন্দা সুব্রত মিত্র। এর পর সম্প্রতি বরযাত্রী সঙ্গে নিয়ে বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে সুব্রত বসেন বিয়ের পিড়িতে, সাত পাকে বাঁধা পড়েন প্রেয়সী ফাল্গুনী সাহার সঙ্গে।
বেশ ছোটবেলায় নিজের দুহাত হারিয়েছেন ফাল্গুনী। তবে, নিজেকে কখনোই দুর্বল মনে করেনি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করে এখন কাজ করছেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।
দুই পরিবারের সম্মতিতেই গত বুধবার রাতে বরিশাল নগরীর ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী শংকর মঠ মন্দির প্রাঙ্গণে বিয়ে হয় সুব্রত-ফাল্গুনির। স্থানীয়রাও জড়ো হন এ বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে। বর সুব্রত মিত্রর মহানুভবতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উচ্চকিত প্রশংসা করেন উপস্থিত ব্যক্তিরা।
সুব্রত মিত্র পটুয়াখালীতে বেসরকারি সংস্থায় ফিল্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি ফাল্গুনীও পিছিয়ে নেই। তিনি বরিশালে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় সহকারী মানবসম্পদ কর্মকর্তা পদে কর্মরত। দুজনের বাড়ি গলাচিপায় হলেও, ফাল্গুনী নগরীর ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন।
ফাল্গুনী সাহা বলেন, ‘২০০২ সালে গলাচিপায় আমাদের পাশের বাড়ির ছাদে বৈদ্যুতিক তারে দুর্ঘটনার কারণে আমার দুহাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু, আমি নিজেকে কখনও দুর্বল মনে করিনি। দুহাতের যতটুকু অংশ ছিল, ততটুকু অংশ দিয়েই আমি আমার পড়াশোনা শেষ করেছি এবং এখন চাকরিও করছি।’
‘আমি ২০১১ সালে মাধ্যমিক পাস করেছি গলাচিপা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৩ সালে উত্তরা ট্রাস্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফি ও এনভায়রনমেন্টে ২০১৮ সালে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করি। তারপর চাকরি জীবনে প্রবেশ করি।’
ফাল্গুনী আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনারা সবাই অবগত। দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতা ঠিক থাকলে প্রতিবন্ধকতা কোনো সাবজেক্ট নয়। আমাদের বিয়েটা দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মনে করি। এ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে প্রতিকূলতা পেরোতে হয়নি। সবারই আন্তরিকতা পেয়েছি। আমার স্কুলজীবন থেকে কর্মজীবনে যারা আমার সঙ্গে রিলেটেড, তারা কেউ আমাকে বুঝতে দেয়নি আমার সমস্যার বিষয়ে। আসলে কার মেন্টালিটি কেমন, সেটা তার তার ওপর ডিপেন্ড করে। যার মেন্টালিটি ভালো, সে এগিয়ে আসবে। যার পক্ষে এমন বিয়ে সম্ভব নয়, তার দূরে থাকাই ভালো। কারও ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। আপনারা সবাই আমাদের জন্য আশীর্বাদ ও দোয়া করবেন, যাতে সামনের দিনগুলোতে আমরা ভালো থাকতে পারি, ভালো কিছু করতে পারি।’
বর সুব্রত মিত্র বলেন, ‘ফাল্গুনীকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। ও যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, তখন ওর সঙ্গে আমার ফেসবুকে কথা হতো। একটা সময় বুঝতে পারি—ও পড়াশুনায় অনেক ভালো করছে, তবে ওর ফ্যামিলি লাইফ বা সামনের দিকে এগানোর কোনো চিন্তা-চেতনা ছিল না। ওর হাত নেই, এটা আমার কাছে কোনো সমস্যা মনে হয়নি। একটা মানুষের হাত নেই, তাই সে বিয়ে করতে পারবে না, তার ফ্যামিলি হবে না—এমনটা হতে পারে না এবং এমন চিন্তা-চেতনা আমারও নাই। আমি ওকে স্বপ্ন দেখাই, আমি ওকে ভালোবাসা শেখাই এবং ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত জানাই। অবশেষে আমরা বিয়েও করেছি। আমরা সামনের দিনে যেন ভালো থাকতে পারি, এর জন্য আমাদের জন্য সবাই আশীর্বাদ করবেন।’
সুব্রত মিত্রর ছোট বোন শ্রাবন্তী বলেন, ‘আর পাঁচটা বিয়ে যেমন হয়, এখানেও সেভাবে বিয়ে হয়েছে। কোনো ঘাটতি নেই। বরং অন্য বিয়ের চেয়ে এ বিয়ে ভালোভাবে হয়েছে। অনেকেই বলতে পারে যে, একটা স্বাবলম্বী ছেলে দুহাত ছাড়া একটি মেয়েকে বিয়ে করছে কীভাবে? আমি বলব—সবার মানসিকতা আমার ভাইয়ের মতো হওয়া উচিত, যাতে বিষয়টি উদাহরণ হয়ে থাকে। আমি মনে করি, সারা বাংলাদেশে আমার ভাইয়ের বিয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
বিয়েতে আগত অতিথি ও স্বজনেরা বলেন, বিয়ের আয়োজনে কোনো ঘাটতি ছিল না। গত মঙ্গলবার এখানে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও হয়েছে। তাঁরা বুধবার সন্ধ্যা থেকেই নাচ-গানসহ নানা আয়োজনে আনন্দ-মজা করেছেন। আনন্দ বাড়াতে প্রদর্শন করা হয় আতশবাজিরও।
শ্রী শ্রী শংকর মঠের সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব কর্মকার ভাষাই বলেন, ‘এ বিয়ে আমার কাছে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ বিয়ে দেখে আমি অবাক হয়েছি। একটা মেয়ের দুটি হাত নেই—তাকে একটি ছেলে বিয়ে করেছে। এমন মহানুভবতা দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। আমরা শ্রী শ্রী শংকর মঠ কমিটির সদস্যেরা উপস্থিত থেকে সহযোগিতাও করেছি বিয়েতে। আমার জীবদ্দশায় দেখিনি একজন দুহাত হারা মেয়েকে এমন স্বাচ্ছন্দ্যে কেউ গ্রহণ করেছে। সুব্রত মিত্রর হৃদয় কতখানি বড় আমরা সেটা বুঝতে পেরেছি। সত্যিই আমরা অভিভূত।’