বায়োফ্লকে মাছ চাষে ভৈরবে ব্যাপক সাড়া
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ। বাড়ির উঠান, বাসার ছাদ বা ফসল হয় না এমন পরিত্যক্ত ভূমি ব্যবহার করে অল্পপরিসরে, স্বল্পপূঁজিতে কমপক্ষে তিনগুণ বেশি মাছ উৎপাদনের আধুনিক এই নতুন চাষাবাদের দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ায় লাভবান হচ্ছেন প্রকল্প গ্রহণকারীরা। ফলে একের সাফল্যে অন্যেরা পদ্ধতিটি গ্রহণ করায় এলাকায় বাড়ছে এর পরিধি। এতে করে স্থানীয়ভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ অধিক মুনাফা লাভ এবং বেকারত্ব দূরীকরণীর উজ্জ্বল সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে খাদ্য-পুষ্টির চাহিদাও। এরমধ্যে অন্যতম খাদ্য অনুসঙ্গ হলো মাছ। মাছ মানবদেহের অন্যতম পুষ্টির যোগানদাতা। বাড়তি জনসংখ্যার মাছ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকারী খাতের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিক পানির উৎস নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরসহ বিভিন্ন জলাভূমি কমে যাওয়ায় প্রাকৃতিক মাছের উৎস ছোট হয়ে আসছে ক্রমশই। এতে করে উৎপাদনশীলতা, সঠিক গুণাগুণ, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার, বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিতকরণ এবং বাজারের চাহিদা মত মাছ সরবরাহসহ সব ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিতকরণের প্রয়োজনে মাছ চাষ প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে।
পানি ও মাটি উল্লেখযোগ্যভাবে কম ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন, একোয়াকালচার পদ্ধতির উন্নতি সাধন, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব দূরীকরণ, মাছ চাষের খরচ হ্রাস এবং লাভের অনুপাত বৃদ্ধিকরণ। টেকসই একোয়াকালচারের লক্ষ্য পূরণে বায়োফ্লক পদ্ধতি অন্যতম। বায়োফ্লক পদ্ধতি ব্যবহার করে অল্প পরিসরে অধিক পরিমাণ মাছ উৎপাদন সম্ভব। যা বাংলাদেশ সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতি মাছ চাষের একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ মাছ চাষ পদ্ধতি। এটি একটি পরিবেশবান্ধব ও পুরোপুরি নিরাপদ পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছ উৎপাদন পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে মাছের ত্যাগ করা মলকে তার খাদ্যে রূপান্তর করা হয়। ফলে ২৫ শতাংশ খাবারে শতভাগ চাহিদা পূরণ হয়। এতে করে মাছ উৎপাদনে খাদ্য খরচ শতকরা ৭৫ ভাগ কম হয়।
অপরদিকে এই পদ্ধতিতে পুকুরে চাষ করা পদ্ধতির চেয়ে অল্প জায়গায় তিনগুণ বেশি মাছ উৎপাদন হয়।
বাড়ির আঙিনায়, বাসার ছাদে অথবা ফসল হয় না-এমন অনুর্বর ভূমিতে বায়োফ্লক প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। সিমেন্ট, রড বা ড্রামের চৌবাচ্চা এবং জমি থেকে ৩/৪ ফুট মাটি তুলে আইল বেঁধে পলিথিনের ত্রিপাল নিচে দিয়ে পানির আধার তৈরি করে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা যায়।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে সফল চাষি শহরের ঘোড়াকান্দা এলাকার হাজি বদরুল আলম ভূঁইয়া বাদল, উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের শম্ভুপুর গ্রামের রায়হান মিয়ার মতে, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ হলো অল্পপূঁজিতে বেশি লাভের একটি পদ্ধতি। যা গ্রহণ করে যে কেউ লাভবান হতে পারেন। এখানে যেহেতু মাছের বর্জ্য থেকে আবার খাবার তৈরি হয়, তাই ৫০০ কেজি খাবার দিয়ে এক হাজার কেজি মাছ উৎপাদন হয়।
তারা জানান, প্রথম অবস্থায় এক লাখ টাকা খরচ করে কেউ ১০ হাজার লিটার পানির একটি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে, তার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ হবে। পরবর্তীতে তার মাছ ও খাবার ছাড়া অন্যান্য বিনিয়োগ না হওয়ায় লাভের অংকটা আরও বেশি হবে। এই হিসেবে যিনি যত বড় পানির আধার তৈরি করবেন, তার তত বেশি লাভ হবে। মাছের উৎপাদনের পরিমাণও বেশি হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উল্লেখ করে তারা জানান, পুকুরে মাছ চাষ করলে কিছু না কিছু ওষুধ দিতে হয়। কিন্তু এখানে তার কোনো প্রয়োজন হয় না। তাই এটি অত্যন্ত নিরাপদ ও জৈবিক। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।

চাকরির পেছনে না ছুটে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত তরুণ/তরুণীরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে বেকারত্ব দূরসহ লাভবান হতে পারেন বলে অভিমত তাদের।
এ ছাড়া মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ দেশের অর্থনীতিতে রাখতে পারেন অবদান। তাদের অভিমত, সরকারি সহায়তায় যদি ভৈরবের মতো সারা দেশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে মাছ উৎপাদনে বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ স্থান থেকে বাংলাদেশ প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে ওঠে আসবে।
এদিকে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য জেনে ঢাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগ্রহীরা ভৈরবের বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছচাষিদের কাছে প্রায় প্রতিদিনই আসছেন। তারা সরেজমিনে দেখে গিয়ে নিজ নিজ এলাকায় প্রকল্পটি গ্রহণ করবেন বলে জানান ঢাকার ওয়ারি এলাকার সফিউল্লাহ, নরসিংদীর রায়পুরার বিলকিছ আহমেদ ও ব্রা্হ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের ইমরান চৌধুরী।
ভৈরবের বিভিন্ন বায়োফ্লক থেকে মাছ কিনে নিয়ে বিক্রি করা মাছের ব্যবসায়ী খলিল মিয়া, আক্তার মিয়া ও খুরশিদ আলম জানান, তারা বায়োফ্লক প্রকল্প থেকে মাছ কিনে নিয়ে যায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য আড়ৎ ‘ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তে।‘ সেখান থেকে পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে থাকেন।
তারা জানান, বায়োফ্লকের মাছের বাজার চাহিদা ও দর খুবই ভালো। দেখতে সুন্দর এবং খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের মাছে চাহিদাও প্রচুর।
আধুনিক পদ্ধতিতে যতোগুলো মাছ চাষ পদ্ধতি রয়েছে এরমধ্যে বায়োফ্লক পদ্ধতিকে অন্যতম পদ্ধতি বলে উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. লতিফুর রহমান বলেন, ‘বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে ভৈরব বেশ এগিয়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত এখানে তিনটি ব্যাচে শতাধিক উদ্যোক্তকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এ পর্যন্ত ৬৩ জন উদ্যোক্তা বায়োফ্লকে মাছ চাষ করছেন। যার মধ্যে অনেকেই সফল হয়েছেন। বায়োফ্লক মাছ চাষিদের কয়েকজনকে অনুদান এবং ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।’
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছের চাষ জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এরই মধ্যে ভৈরবে ক্যাটফিস জাতীয় অর্থাৎ তেলাপিয়া, রুই, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা ও চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, যা খুবই আশাব্যাঞ্জক বলে অভিমত ওই মৎস্য কর্মকর্তার।
নতুন করে আরও যারা এই পদ্ধতি মাছের চাষ করতে চান, তাদের বিনা খরচে প্রশিক্ষণসহ সব রকমের সহযোগিতা করবেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা।