মুফতি আব্দুল হাই আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেন : র্যাব
বহুল আলোচিত গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে তৎকালীয় বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা ও রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জঙ্গি সংগঠন হুজি-বি’র প্রতিষ্ঠাতা আমির মুফতি আব্দুল হাইকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাবের দাবি—আব্দুল হাই পাকিস্তানের একটি মাদ্রাসা থেকে ইফতা কোর্স সম্পন্ন করে মুফতি খেতাব অর্জন করেন। পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গতকাল বুধবার রাতে র্যাব-২-এর একটি দল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযান চালিয়ে মুফতি আব্দুল হাইকে (৫৭) গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃতের বিরুদ্ধে সাতটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। যার মধ্যে দুটি মৃত্যুদণ্ড ও দুটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরোয়ানা রয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০০০ সালে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় জনসভার অদূরে মুফতি আব্দুল হাইসহ তাঁর অপরাপর জঙ্গি সদস্যেরা শেখ হাসিনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখার ঘটনায় কোটালীপাড়া থানায় বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনে ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা রুজু হয়। তদন্ত শেষে ওই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পরবর্তীকালে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট মুফতি আব্দুল হাইসহ ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং চার জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়—রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে প্রকাশ্য দিবালোকে জঙ্গিদের অতর্কিত বোমা হামলার ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলাসহ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করা হয়। এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন আদালত আট জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মুফতি আব্দুল হাই জানান, তিনি নারায়গঞ্জ জেলার দেওভোগ মাদ্রাসায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হেফজ বিভাগে পড়ালেখা করে। এরপর ১৯৮১ সালে অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশে গমন করে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দেওবন্দে পড়ালেখা করে মাস্টার্স সমতুল্য দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। পরে দেওবন্দ থেকে ১৯৮৫ সালের শেষে ওই দেশের নাগরিক হিসেবে একটি পাসপোর্ট তৈরি করে পার্শ্ববর্তী দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮৬ সালে পুনরায় সে দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাকিস্তানি ভিসা নিয়ে ট্রেনে পাকিস্তানের করাচিতে গমন করে সেখানকার একটি মাদ্রাসা থেকে দুই বছরের ইফতা কোর্স সম্পন্ন করে মুফতি টাইটেল অর্জন করে। ১৯৮৯ সালে ওই মাদ্রাসায় একাধিক বাংলাদেশিসহ বেশ কয়েক জন পাকিস্তানি মিরানশাহ বর্ডার দিয়ে আফগানিস্থানে মুজাহিদ হিসেবে গমন করেন। সেখানে বাংলাদেশের কয়েক জন জঙ্গি সদস্য এবং ৩০ থেকে ৩৫ জন পাকিস্তানি নাগরিক একত্রিত হয়ে একটি ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি এক হুজি নেতা এবং বাংলাদেশি এক জঙ্গির নেতৃত্বে এ কে ৪৭ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে আফগানিস্তানে গিয়ে তাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেন। এরপর ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উল্লিখিত ব্যক্তিরা আফগানিস্তানে থাকাকালীন ‘হুজি-বি’ অর্থাৎ ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার আমির নির্বাচিত হন মুফতি আব্দুল হাই। পরবর্তীকালে মুফতি আব্দুল হাই আমির হিসেবেই বাংলাদেশে আসেন এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদ নামে প্রচারণা শুরু করেন।
এরপর ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে আব্দুল হাই কক্সবাজারের উখিয়ার একটি মাদ্রাসায় যান এবং সেখানে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করেন। পার্শ্ববর্তী দেশের এক জঙ্গি নেতা ওই ট্রেনিং ক্যাম্পে অস্ত্র সরবরাহ করতেন এবং মুফতি আব্দুল হাই ও তাঁর দুই সহযোগী সেখানে প্রশিক্ষণ দিতেন।
মুফতি আব্দুল হাই ‘জাগো মুজাহিদ’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি ১৯৯১ সালে চালু হয় এবং এর অফিস খিলগাঁওয়ের তালতলায় ছিল। পরবর্তীকালে ২০০০ সালে সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। মুফতি আব্দুল হাই ২০০০ সালে পত্রিকার অফিস থেকেই গ্রেপ্তার হন এবং দুই মাস কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্তি পান।