মোংলায় মেগা প্রজেক্ট ঘিরে শক্তিশালী চোরচক্র
মোংলা বন্দরের শিল্পাঞ্চলসহ সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ঘিরে শক্তিশালী চোরচক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্রের সদস্যরা লুটপাট করছে চলমান উন্নয়নমুখী প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ মালামাল।
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় কোস্ট গার্ডের অভিযানে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লোপাট হওয়ায় প্রায় পৌনে এক কোটি টাকার মালামাল জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু এরই ফাঁকে কয়েক দফায় পাচার হয়েছে লাখ লাখ টাকা মূল্যের মালামালও। প্রতিনিয়তই সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আমদানি পণ্য দেদারছে লুটতরাজ করছে এ চক্রটি। এতে আর্থিক ক্ষতিসহ উন্নয়নমুখী প্রকল্পের কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান সকারের আমলে এক সময়ের মৃত প্রায় মোংলা সমুদ্রবন্দর প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজের আগমনও। আর বন্দরের গতিশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হয়ে উঠেছে বিভিন্ন চোরাকারবারি চক্র। এ চক্র বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি বন্দর এলাকায় অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও হানা দিচ্ছে। নিরাপত্তাকর্মীসহ বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে লুটে নিচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ক্যাবল, মেশিনারিজ যন্ত্রাংশ, এসএস পাইপ, কাস্টিক, তামা, লোহা, জেনারেটরসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে না আসতেই এই চক্রের সদস্যরা নেমে পড়ে চুরি ও লুটের কাজে। সাম্প্রতিক সময় এ চক্রের সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের চোরাই ও লুণ্ঠিত মালামাল চিলা, জয়মনি ও কানাইনগরসহ মোংলা পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় মজুদ করে রাখা হয়ে থাকে। পরে তা ট্রাকযোগে পাঠানো হয় খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কোস্ট গার্ডের দুই দফা অভিযানে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকার চোরাই মালামালসহ দুটি ট্রলার আটক করা হয়।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হাসানুজ্জামান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রথম দফায় কানাইনগর পশুর নদ এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৫০ কেজি ওজনের ২৩টি (২০ ফুট) এসএস পাইপ, নৌকাসহ রবিউল শেখ (২৫) নামের এক চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই এলাকায় দ্বিতীয় দফায় পরিত্যক্ত অবস্থায় চোরাই ৩৫০ কেজি ওজনের নয়টি (২০ ফুট) এসএস পাইপ ও ৬০ কেজি ওজনের ৩৯টি (১৮ ফুট) এসএস পাইপ জব্দ করা হয়। উদ্ধারকৃত মালামালের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৬৮ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে জব্দকৃত মালামালসহ গ্রেপ্তারকৃত চোরাই সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যকে মোংলা থানায় সোপর্দ করা হয়। এ খবর পেয়ে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালসের প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামসহ চার সদস্যের প্রতিনিধিদল থানায় এসে ওইসব মালামাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাচার করে আনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের কাজের জন্য ওই মালামাল ভারত থেকে আনা হয়েছিল। বিভিন্ন সময় আরও লাখ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লোপাট হয়েছে। আর এ ঘটনায় রামপাল থানায় একাধিক অভিযোগ ও মামলা রয়েছে।’
তবে প্রকল্পের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে কীভাবে চোরাকারবারী গ্রুপের আনাগোনা সেই প্রশ্নে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, রামপাল তাপ বিদুৎকেন্দ্রসহ স্থানীয় শিল্পাঞ্চল ও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রকল্পকে টার্গেট করে কানাইনগর এলাকায় শক্তিশালী একটি চোরাকারারী সিন্ডিকেট চক্র তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে এ চক্রের সদস্যরা ট্রাকে খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগামে লাখ লাখ টাকা মূল্যের চোরাইপণ্যের চালান পাচার করেছে। মোংলার কানাইনগর বাইদ্দাপাড়াকেন্দ্রিক এ চোরচক্রের সদস্যদের মধ্যে রাজু মুন্সি, বাবলু, জুয়েল ব্যাপারী, মোস্তাকীন, বাপ্পা খাঁ, শাকিল ব্যাপারী, হাসান, একরামুল ব্যাপারী, রাজ্জাক ব্যাপারী, এনাম খাঁ, নেয়ামুল, কাশেম ব্যপারী ও ইস্রাফিল ব্যাপারী। গভীর সমুদ্র থেকে শুরু করে পশুর চ্যানেলে বন্দর কর্তৃপক্ষের স্থাপিত মার্কিং বয়াও রক্ষা পায়নি। এ চক্রের অধীনে এখনও কয়েক লাখ টাকা মূল্যের মালামাল মজুদ রয়েছে। কানাইনগর খাল ও আশপাশের খালে এসব মালামাল মজুদ রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল নিয়ন্ত্রণ করছে পুরো চক্রটি। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দুই একজন ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে প্রভাবশালী মহলটি।
চোরচক্রের তৎপরতা প্রসঙ্গে মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কোস্ট গার্ডের অভিযানে জব্দ হওয়া মালামাল ও এক চোরাকারবারি গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় মোংলা থানায় একটি মামলা হয়েছে। এ মামলার সূত্র ধরে পুলিশ তদন্ত করছে। একইসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।’
আসামিকে রিমান্ড নিলে চোরচক্রকে দ্রুত শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলেও জানান ওসি।