রঙ খেলা ও নৃত্যে রঙিন ফাগুয়া উৎসব
রঙের খেলা, প্রাণের মেলা ছিল দিনটি। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই বাহারি রঙের ছড়াছড়ি। সব বয়সী নারী-পুরুষ মেতে ওঠে এই দিনে। দিনটি ছিল ফাগুয়া উৎসবের। এই উৎসবে একে অপরের দিকে রঙে ছুড়ে রঙিন করে দেন, সেই সঙ্গে ছিল নৃত্য ও গান। সব কিছু মিলিয়ে মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে মেতেছিল চা জনগোষ্ঠী। এই উৎসব উপভোগ করতে ছুটে এসেছিলেন দেশি ও বিদেশি অতিথিরা।
গত তিন বছর ধরে ফাগুয়া উৎসব বৃহৎভাবে উদযাপন করা হচ্ছে শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা বাগান মাঠে। গতকাল শনিবার (১১ মার্চ) বিকেলে ঘণ্টা বাজিয়ে ফাগুয়া উৎসবের উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। এতে গেস্ট অব অনার ছিলেন সিলেটের ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার নীরাজ কুমার জায়সওয়াল।
চা শ্রমিক সন্তান প্রকাশ ভর ও পিংকি বর্মার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ লিটন, ফাগুয়া উৎসবের আহ্বায়ক ও রাজঘাট ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনাজী, সদস্য সচিব এবং কালিঘাট ইউপি চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালাসহ অনেকে।
বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে নানান জাতিগোষ্ঠির বাস। চা শ্রমিকদের যেমন নিজেদের পৃথক ভাষা, তেমন পৃথক সংস্কৃতিও রয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতিতে একেকটি চা বাগান যেন একেকটি দেশ। তবে ফাগুয়া উৎসবে এসে সবাই এক হয়ে মেতে ওঠে রঙের উৎসবে। চা-শ্রমিকের অংশগ্রহণে গতকাল বিকেল থেকে শুরু হওয়া ফাগুয়া উৎসবটি চলবে সাত দিন।
উৎসবে থাকছে চা শ্রমিকদের ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তত ৩০টি পরিবেশনা। পত্রসওরা, নৃত্যযোগি, চড়াইয়া নৃত্য, ঝুমর নৃত্য, লাঠি নৃত্য, হাড়ি নৃত্য, পালা নৃত্য, ডং ও নাগরে, ভজনা, মঙ্গলা নৃত্য, হোলিগীত, নিরহা ও করমগীত একসঙ্গে উপভোগ করতে পেরে যেমন আনন্দে ভেসেছেন চা শ্রমিকরা, তেমন অভিভূত হয়েছেন উৎসবে আসা নাগরিক সমাজও।
ফাগুয়া উৎসব উদযাপন পরিষদের আহবায়ক বিজয় বুনার্জী বলেন, ‘প্রায় পৌনে ২০০ বছর আগে যারা এসেছিল সেসব চা শ্রমিকদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য এই আয়োজন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় চা জনগোষ্ঠীদের নিজস্ব সংস্কৃতি। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে আর চৈত্র মাসের প্রথম দিকে পূর্ণিমা তিথিতে চলে এ উৎসব। রঙ খেলার পাশাপাশি তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ আর গান উৎসবে বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান ভানু লাল রায় বলেন, ‘এ অঞ্চলের আলোচিত উৎসব হচ্ছে ফাগুয়া উৎসব। এ উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন সর্বস্থরের মানুষ।’ এ উৎসবকে আনন্দ মূখর করতে আরও সরকারি পৃষ্টপোষকতার দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।
ভারতীয় সহকারী কমিশনার নীরাজ কুমার জায়সওয়াল বলেন, ‘চা বাগানে পৌঁছাতেই কানে বাজল পাহাড়িয়া মাদলের সুর। চা বাগানের অন্য পাড়ায় গেলেও গিয়েও চোখে পড়ল একই দৃশ্য। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী সবাই নাচছে, গাইছে আনন্দ করছে। অনেক আয়োজন দেখেছি, তবে এমন আয়োজন প্রথম দেখলাম। চা বাগানের মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এতো সুন্দর, না দেখলে বুঝতে পারতাম না।’
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘চা জনগোষ্টির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি যেন কোনোভাবে বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য বড় পরিসরে উৎসব উদযাপনে সহযোগিতায় রয়েছে জেলা প্রশাসন। ফাগুয়া উৎসবসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সংস্কৃতি রক্ষায় সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।’