রাজধানীতে স্ত্রী ও দুই সন্তান হত্যার রায় আজ
রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় দুই শিশু সন্তানসহ স্ত্রীকে লোমহর্ষকভাবে হত্যার অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের (বিটিসিএল) সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনের বিরুদ্ধে আজ রোববার (২২ জানুয়ারি) রায় ঘোষণা করবেন আদালত। ঢাকা মহানগর ৭ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক তেহসিন ইফতেখার এর আজ দুপুরে এ রায় ঘোষণার কথা রয়েছে।
আদালতের অতিরিক্ত পিপি মাহবুবুর রহমান ও পেশকার ফারুক হোসেন এনটিভি অনলাইনকে গতকাল শনিবার (২১ জানুয়ারি) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত নভেম্বরে এ চাঞ্চল্যকর মামলায় শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ২২ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।
কেন কীভাবে ঘটল এমন ঘটনা
মামলার এজাহার ও চার্জশিট থেকে ঘটনার বিবরণে জানা যায়, নিহত মুন্নী রহমান (৩৭) ও রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটন (৪৬) সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন ছিলেন। তাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাতশালা গ্রামে। রাজধানীতে দক্ষিণ খানের প্রেমবাগান এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। মামলার বাদি নিহত মুন্নির ভগ্নিপতি সোহেল আহমেদ বলেন, প্রেম করে প্রায় এক যুগ আগে তারা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল বলেই আমরা জানতাম।
মামলার বাদি নিহত মুন্নি রহমানের বড় ভাই মুন্না রহমান ঘটনার পর ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ থানায় হাজির হয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ‘আমি মুন্না রহমান (৪২) থানায় হাজির হয়ে অভিযোগ করছি যে, আমার ছোট বোন মুন্নি রহমানের (৩৭) সঙ্গে ১৩ বছর আগে বিবাদী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনের (৪৬) বিয়ে হয়। তাদের দাম্পত্য জীবনে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব (১২) ও লাইবা (৩) নামের দুটি সন্তান আছে। আসামি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে উত্তরায় কর্মরত। ২০১১ সাল থেকে আমার বোন তার পরিবারসহ রাজধানীর দক্ষিণ খানের প্রেমবাগান এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। এ বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস করা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে আমার ছোট বোন মুন্নি রহমান আমাকে মোবাইল ফোনে জানায় যে, ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর রাতের বেলা খাওয়াদাওয়া শেষে আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে সে এবং তার স্বামী রফিক উদ্দিন আহম্মেদ বাচ্চাসহ একত্রে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে সকাল সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, তার স্বামী রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ বাসায় নাই। অনেক খোঁজ করার পরও তার সন্ধান পাওয়া যায় না। পরে আমি আমার বোন মুন্নি রহমানের বাসার উদ্দেশে রওনা হই। বিকেলে উপস্থিত হয়ে ঘটনার বিস্তারিত শুনি। পরে আমাদের নিকটতম আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তারপর বিবাদীর (আমার বোন জামাই) ভাই সোহেল আহম্মেদ রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় উপস্থিত হয়ে নিখোঁজ হয়েছে মর্মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।’
জিডির পর জানতে পারি যে, ‘বিবাদী কুমিল্লার বুড়িচং থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। এ খবর পাওয়ার পর আমিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ওই থানায় গিয়ে জানতে পারি যে, রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ কুমিল্লার বুড়িচং এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিবাদীকে আমার জিম্মায় দিয়ে দেয় পুলিশ। বিবাদী শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাতদিন ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিবাদী কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করেন চিকিৎসক। চিকিৎসা শেষে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার কারণ জানতে চাইলে রাকিব উদ্দিন জানান, তিনি এক কোটি টাকার মতো ঋণগ্রস্ত এবং পাওনাদাররা টাকার জন্য তাকে খোঁজাখুঁজি করছেন।’
‘২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার মেজ বোন পারভীন আক্তার আমাকে মোবাইল ফোনে জানায় যে, মুন্নির দুটি মোবাইল ফোন নম্বরের মধ্যে একটি নম্বরে কল হয় ধরে না। আরেকটা বন্ধ আছে। এছাড়া রাকিবের নম্বরও বন্ধ। ওইদিন রাত ৮টার দিকে আমি আমার বাসার পাশে মেজ বোনের বাসায় গেলে সে আমার ফোন না ধরায় এবং রকিবের ফোন বন্ধ থাকায় দক্ষিণখান থানাধীন মধুবাগে বসবাসকারী আমার খালাতো বোন সোনিয়াকে মুন্নির বাসায় খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। সোনিয়া মুন্নির বাসার উপস্থিত হয়ে দরজা তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখে। বিষয়টি নিয়ে আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলে মুন্নির বাসার মালিক মো. মনোয়ার হোসেনের নম্বরে কল করে তার বাসায় থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করার জন্য অনুরোধ করি। কিছু সময় পর পুনরায় বাড়ির মালিককে ফোন করলে জানান, তিনি সিসি ক্যামেরা অপারেট করতে পারেন না এবং অপারেট করার মতো লোকও পাচ্ছে না। তখন আমি ও আমার অপর বোনের জামাই (বিবাদীর বড় ভাই) সোহেল আহম্মেদ বোন মুন্নির বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।’
হত্যার বিবরণ দিয়ে মামলার বাদী জানান, ‘‘পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি আমি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইরে থাকার কারণে সোহেল আহম্মেদ আমার খালাত ভাই সজিবকে মুন্নির বাসায় পাঠায়। পরে সজিব আমাকে ফোনে জানায় যে, ‘সব শেষ’। কী হয়েছে আবার জিজ্ঞাসা করলে সজিব পুনরায় একই কথা বলতে থাকে। এরপর বাদির আরেক বড় বোনের জামাই সোহেল আহম্মদকে ফোন করলে তিনি আমাকে বলেন, ‘বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তুমি তাড়াতাড়ি মুন্নির বাসায় আস।’ খবর পাওয়ার পর আমি বিকেল পাঁচটার দিকে মুন্নির বাসায় যাই। গিয়ে দেখি, সেখানে পুলিশসহ আরও লোকজন রয়েছে। পরবর্তীতে সোহেল আহম্মেদ জানান, বিকেল চারটার দিকে মুন্নির বাসার নিচতলায় উপস্থিত হলে বাড়ির মালিকের সঙ্গে মালিকের রুমে বসে সিসি ক্যামেরা চেক করার চেষ্টা করেন। সিসি ক্যামেরা অপারেট করতে না পারায় বাড়ির মালিকসহ তালা চাবির মেকার এনে বাদীর বোনের ফ্ল্যাটের মেইন দরজার তালা খোলার সাথে সাথে রুমের ভেতর থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হয়। বেড রুমে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ইতোমধ্যে সিআইডির কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে মুন্নি রহমান (৩৭) ও ভাগ্নি লাইবা (৩) উভয়ের মৃতদেহ ফ্ল্যাটের পূর্বপাশের রুমের খাটের উপরে চিৎ অবস্থায় এবং ভাগনে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব (১২) এর মৃতদেহ ফ্ল্যাটের পশ্চিম পাশের রুমে মেঝেতে চিৎ অবস্থায় দুর্গন্ধযুক্ত, পচা ফুলা অবস্থায় পায়।’’
মামলার বাদী এজাহারে বলেন, ‘২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামি রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ বাদীর বোন, ভাগনে ও ভাগনিকে হত্যা করে ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে কৌশলে পালিয়ে যায়।’
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে হত্যার যেসব চিহ্ন
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরিকালে বাদীর বোন নিহত মুন্নি রহমানের মাথার ওপরে হাতুড়ির আঘাতের চিহ্ন, ভাগ্নি লাইবার গলায় আঙুলের চাপের চিহ্ন ও ভাগনে ফারহান উদ্দিন বিপ্লবের গলায় জুতার ফিতা পেঁচানো অবস্থায় দেখতে পান।’
স্ত্রী ও দুই সন্তানকে যেভাবে হত্যা করা হয়
মামলার চার্জশিটে নিহতদের হত্যার বিবরণে দেখা যায়, ‘‘আসামি রকিব উদ্দিন লিটন স্ত্রী ও সন্তানকে নিজ হাতে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার কথা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়, সে বিটিসিএল এর জুনিয়র সহকারী ম্যানেজার পদে চাকরি করে। সে যাদেরকে হত্যা করেছে তারা তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে হয়। তার স্ত্রীর নাম মুন্নী রহমান, ছেলের নাম ফারহান উদ্দিন ও মেয়ের নাম লাইবা রহমান। ছেলের বয়স ১২ বছর, মেয়ের বয়স ৩ বছর ৮ মাস। আসামি বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি পনের লাখ টাকার মতো সুদে নিয়েছিল। পাওনাদারদের টাকা দিতে পারতেছিল না। পাওনাদারগণ বাড়িতে এসে যা তা বলত। সে সুদের টাকার জন্য মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ছিল। ঘটনার দিন বাসায় কোনো ঝগড়া হয়নি। তবে সে খুব চিন্তিত ছিল এবং নিজেকে শেষ করতে পারতেছিল না। হঠাৎ কী যে হয়, ঘটনার দিন সকালবেলা সে হাতুড়ি দিয়ে তার স্ত্রীর মাথায় জোরে আঘাত করে স্ত্রী শুয়ে থাকাবস্থায়। স্ত্রী ঐ সময় মারা যায়। উক্ত আসামি তার স্ত্রীকে মারিয়া বেশ কয়েকটি আঘাত করে এবং গলা টিপে ধরে। তখন তার মেয়েটি টিভি রুমে টিভি দেখার সময় উক্ত আসামি রশি দিয়ে মেয়েটির গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করে। তারপর মেয়ের লাশ নিচে স্ত্রীর পাশে শুইয়ে রাখে। ছেলেটি তার দাদুর রুমে ঘুমাচ্ছিল। আসামি রশি দিয়ে ছেলের গলায় পেঁচানোর সময় ছেলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, অনেক হাউ মাউ করে কাঁদে। তারপর জোর করে ছেলেটির গলায় রশি পেঁচিয়ে ধরে। ছেলেটি ঐ জায়গায় মারা যায়। তারপর উক্ত আসামি নেশার ঘোরে নোটে কী যেন লিখতে থাকে। এরই মধ্যে কলিং বেল বেজে ওঠে। কাজের বুয়া আসে। কাজের বুয়াকে বলে আজ কাজ করা লাগবে না। অতঃপর কাজের বুয়া চলে যায়। কাজের বুয়া চলে গেলে উক্ত আসামি তাদের লাশ ঘরের মধ্যে রেখে তালা মেরে চলে যায়। আসামি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে। এরপর কি হয়েছে তা সে জানে না। সে পাগলের মতো ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরে পাবার পর দেখে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। তারপর পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। উক্ত আসামি কিসের জন্য তার স্ত্রী ও বাচ্চাদের হত্যা করেছে, সে কিছুই মনে করতে পারতেছে না। তবে সে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তবে সে আত্মহত্যা করতে পারেনি। ঋণের টাকার জন্য হতাশ হয়ে সে এই কাজ করেছে। সে অপরাধ করেছে। সে উক্ত ঘটনায় অনুতপ্ত।”
আমরা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব বলে ছেলেকে মেরে ফেলে
স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যার পর পালিয়ে বেড়ানো রাকিব উদ্দিন ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। রাজধানীর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপ-কমিশনার মশিউর এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রাকিব জানিয়েছেন স্ত্রী মুন্নী, ছেলে ফারহান ও মেয়ে লাইবাকে নিয়ে দক্ষিণখানের ওই ভবনের চতুর্থ তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড-বিটিসিএলে কনিষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে উত্তরায় কর্মরত ছিলেন। সংসারে মাঝে মাঝে টুকটাক পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা হলেও সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে একত্রে বসবাস করছিলেন।
‘অফিসের কলিগসহ অন্যান্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা সুদের ওপর বিভিন্ন সময়ে ধার নিয়েছিল। অনলাইনে জুয়া খেলে সে সব টাকা নষ্ট করে। এদিকে পাওনাদাররা তাদের পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। এ কারণে সে বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের সাথে খারাপ আচরণ করত এবং গত ডিসেম্বর মাসে সে কিছু দিন আত্মগোপনে ছিল। তখন তার পরিবার দক্ষিণখান থানায় জিডি করে। কিন্তু কিছু দিন পরে সে বাসায় ফিরে আসে।’
‘পাওনাদারদের টাকার চাপে সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সময় আলোচনা করলেও তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে তার জুয়া খেলার কারণে বিশ্বাস করত না। তখন পাওনাদারদের বিভিন্ন চাপের কারণে রাকিবের স্ত্রী মুন্নী ও তার ছেলে ফারহান তাকে বলে, এভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী? আমাদের কাউকে দিয়ে মেরে ফেল, এভাবে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। পাওনাদারদের চাপ, আত্মীয়-স্বজনদের অবিশ্বাস এবং স্ত্রী-সন্তানদের বিভিন্ন কথা তার অসহ্য লাগে।’
জিজ্ঞাসাবাদে রাকিবের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর বলেন, ‘১২ ফেব্রুয়ারি রাকিব, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা দেরিতে নাস্তা করেন। নাস্তা শেষে রাকিব স্ত্রীর সাথে গল্প করেন। গল্প শেষে সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে মুন্নী হালকা ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলে ফারহান পাশের রুমে মোবাইলে গেম খেলছিল, আর মেয়ে লাইবা পাশের এক রুমে টিভি দেখছিল। সে সময়ে হঠাৎ লিটনের মাথায় চিন্তা আসে যে, এই দুনিয়ায় সে তার পরিবারসহ বেঁচে থেকে লাভ কী বরং তাদের সবাইকে মেরে সে নিজে আত্মহত্যা করলে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সন্তানসহ সে নিজে পাওনাদার ও অন্যান্য দুনিয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।’
‘তখনই সে তার পাশে থাকা হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে এবং গলাচেপে ধরে। তখন রাকিবের স্ত্রী তাকে বলে, তুমি আমাকে মারলে কেন, এ বলে সে নিস্তেজ হয়ে যায়। পরে লিটন টিভি রুমে গিয়ে কাপড়ের রশি দিয়ে মেয়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে, মেয়ে মারা যাওয়ার পর আবার সে তার ছেলে ফারহানের রুমে যায়। ছেলে তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। মেয়েকে যে রশি দিয়ে মেরেছিল সেই রশি দিয়ে ছেলের গলায় পেঁচিয়ে ধরে। তখন ছেলে টের পেয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করে। এক পর্যায়ে ছেলে খাট থেকে নিচে পড়ে যায়। তখন লিটন ছেলের বুকের ওপর চড়ে বসে এবং চাপ দিয়ে ধরে। তখন ছেলে বলতে থাকে, বাবা তুমি আমাকে মারতেছ কেন? আমার কী অপরাধ? এই বলে ছেলে লিটনের হাতের ওপর আঁচড়াতে থাকে এবং ছেলের নখের আঁচড়ে লিটনের হাত কেটে যায়। এক পর্যায়ে লিটন ছেলেকে বলে, আমরা এ পৃথিবীতে কেউ থাকব না। আমরা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব বলে ছেলেকেও মেরে ফেলে।’
এরপরে লিটন নিজেও ‘আত্মহত্যার চেষ্টা করেন’ জানিয়ে মশিউর রহমান বলেন, “রাকিব বলেছে, স্ত্রী-সন্তানদের মেরে ফেলার পর সে নিজে নিজে বলতে থাকে, আমি পাপী, তোমরা নির্দোষ। তোমাদের পাশে আমি মরব না, আমি মরব রাস্তার পাশে বা রেললাইনের ধারে। যেন আমার লাশ শিয়াল কুকুরে খায়। পরে সে বাসায় তালা দিয়ে বিকেল ৪টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রেললাইনে যায়। ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রেন না আসায় সে আত্মহত্যা করতে পারেনি। আত্মহত্যা করতে না পেরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষুক এবং পাগলের ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘুরতে থাকে।”
মা ও দুই শিশুর লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি ডায়রি উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে পাঠানো হয়। সেই ডায়রিতে লেখা ছিল, “আজ ১২ তারিখ। সবাইকে মুক্তি দিয়ে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান যেন কারও কাছে হেয় না হয়। আমাকে পাওয়া যাবে রেললাইনে।”