রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন
সদ্য প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক নেতা ও সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ আমৃত্যু গণতন্ত্র এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। জীবনের শেষদিকে মুক্ত গণমাধ্যমের স্বপ্ন দেখে গেছেন প্রখ্যাত এই সাংবাদিক নেতা। তাঁর মৃত্যুতে দেশ হারিয়েছে একজন দেশপ্রেমিককে, সাংবাদিকরা হয়ে পড়েছে অভিভাবকহীন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার ও স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হবে।
আজ শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক নাগরিক শোকসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এ শোকসভার আয়োজন করে। বিএফইউজের সভাপতি এম. আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধমে স্মরণ সভা শুরু হয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরেণ্য সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের কর্মময় জীবন স্মরণ করে বলেন, বিভিন্ন সময় জাতির সংকটময় মূহর্তে তিনি অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দালনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে তাঁর মতো একজন দায়িত্বশীল, পরিশীলিত ও সাহসী মানুষের বড় বেশি প্রয়োজন। রিয়াজভাই পথ দেখিয়ে গেছেন কীভাবে সংকট মোকাবিলা করতে হয়।
নতুন বছরে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সময় এতটা খারাপ যাচ্ছে যে, টিকে থাকাই কঠিন। তবে মানুষ জেগে উঠেছে। বিভিন্ন কর্মসূচির সফলতা আমাদের আশা জাগিয়েছে। আমরা সবাই যদি সাহসের সঙ্গে ওঠে দাঁড়াতে পারি, তাহলে এই দানবীয় সরকারকে সরাতে পারব। এ সময় তিনি মরহুম রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যারা সব সময় সত্যের পক্ষে কথা বলতে পারেন রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেরকম মানুষ। তাঁর মতো মানুষ বর্তমানে বিরল। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ মন্ত্রিত্ব-এমপি হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে শুধু সাংবাদিক থাকতে চেয়েছিলেন। অথচ বর্তমানে সর্বত্র মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখতে পাই। ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে রাতে ডাকাতি করে ক্ষমতায় বসে আছে। তারা নির্বিচারে সত্যের অপলাপ করে চলেছে। তবে তাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। রিয়াজ ভাই সেই বিজয় দেখে যেতে পারলেন না।
বিএফইউজে ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতা ছিল তার প্রাণ। সাংবাদিকতার মধ্য দিয়েই তিনি জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি সাংবাদিক আন্দোলনে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন সময়ের সাহসী ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ দেশ, জীবনধর্মী এবং গণতন্ত্রবাদী সাংবাদিকতার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শওকত মাহমুদ তাঁর (রিয়াজ উদ্দিন) লেখা একটি বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “বারবার গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ফসল জনগণ পাচ্ছে না।”
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ বলেন, যারা দেশকে ভালোবাসতেন, বর্তমান দুঃসময়ে তারা একে একে চলে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান, শিক্ষাবিদ ড. পিয়াস করিম। সর্বশেষ রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। দুঃসহ স্বৈরশাসন মানসিক চাপ সৃষ্টি করে বলেই তারা অসময়ে চলে গেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল উল্লেখ করে রিজভী বলেন, তিনি ছিলেন দ্রৌপদী আর আধুনিক চরিত্রের সমাহার। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে এর থেকে উত্তরণে সাংবাদিকদের ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করেন রিজভী বলেন, সাংবাদিকরা কলম ও কণ্ঠ অব্যাহত রাখলেই রিয়াজ ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএফইউজের সভাপতি এম. আবদুল্লাহ বলেন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে সাংবাদিকরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার লড়াই সাহসের সঙ্গে চালিয়ে যেতে পারলেই রিয়াজ ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ দেশে সাংবাদিকতা প্রসারে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের ভূমিকা স্মরণ করে বলেন, সাংবাদিকতাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন সফল। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন মুক্তমনের দেশপ্রেমিক। যারা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, রিয়াজ ভাই লেখনীর মাধ্যমে তাদের অনুপ্রেরণা দিতেন।
বিএফইউজের মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন বলেন, সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বাধীন গণমাধ্যম ছিল রিয়াজ ভাইয়ের চাওয়া। নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতন ত্বরান্বিত করতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ পেশা ও ইউনিয়ন কাজে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে ৪৩ বছরের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, রিয়াজ ভাই ছিলেন অসীম সৌহার্দ্যের মানুষ। কঠিন কথা বললেও কখনও তাকে রাগান্বিত হতে দেখিনি। তিনি উদার গণতান্ত্রিক ছিলেন। অবিভক্ত ইউনিয়নকে কখনও রাজনৈতিক আবর্তে জড়াননি। ইউনিয়নকে পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন।
ডিইউজের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বিভক্ত ফোরাম ও বিভক্ত ইউনিয়নের নেতা হয়েও রিয়াজ ভাই ছিলেন সবার নেতা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনি বর্তমান ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনেও তিনি থাকতের সামনের সারিতে। তাঁর মৃত্যু রাষ্ট্রের জন্য বড় ক্ষতি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান শেষ জীবনে রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের মনোকষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, বিভিন্ন সময় আলাপচারিতায় গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরা নিয়ে রিয়াজ ভাইয়ের প্রবল আক্ষেপ দেখা গেছে।
ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, রিয়াজ ভাই গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন করে গেছেন, আমাদের তা অব্যাহত রাখতে হবে।
স্মরণ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম এবং সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, বিএনপিনেতা ও সাবেক ডাকসুর জিএস খায়রুল কবীর খোকন, জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, এবি পার্টির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, সিনিয়র ফটো সাংবাদিক রফিকুর রহমান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন ও জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও এনটিভির পরিচালক নুরুদ্দীন আহমেদ, বিএফইউজের নির্বাহী পরিষদ সদস্য এ কে এম মহসীন, ডিইউজের সহসভাপতি বাছির জামাল, রাশেদুল হক প্রমুখ।