রসরাজ দাসের বাড়িতে হামলা, আ. লীগ নেতা রিমান্ডে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিকে আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের বাসিন্দা রসরাজ দাসের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের মামলায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এ নিয়ে দুটি মামলায় আঁখিকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। এর আগে নাসিরনগরের দত্তবাড়ির মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার ও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নাসিরনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইশতিয়াক আহমেদ জানান, রসরাজ দাসের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর মামলায় আতিকুর রহমান আঁখিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ বুধবার তাঁকে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম শফিকুল ইসলামের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকার ভাটারা এলাকা থেকে আঁখিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ির ও মন্দিরে ভাঙচুর এবং পরবর্তী সময়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় আটটি পৃথক মামলা হয়। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে আতিকুর রহমান আঁখি সহায়তা করেন। তাঁর নির্দেশ ও সহায়তায় সেদিনের তাণ্ডব ঘটে। তিনি ১০ থেকে ১৫টি ট্রাকে করে মানুষ হরিপুর ইউনিয়ন থেকে নাসিরনগর সদরে আনেন। ওই সব ট্রাকের লোকজন পরে হামলা চালায়। তিনি ট্রাকভর্তি মানুষ পাঠিয়ে নাসিরনগরের পরিস্থিতি টালমাটাল করে দেন। বিশেষ নেতাদের ইন্ধনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হককে কুপোকাত করতেই হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বিশেষ নেতাদের অনুকম্পায় আতিকুর রহমান আঁখি এত দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছিলেন। এরপর পুলিশ তদন্ত করে হামলার ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়। গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করলে আঁখি গা-ঢাকা দেন। তাঁর অবস্থান জানতে এর আগে ব্যক্তিগত সহকারী ও ইউপি সচিবকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
গত ২৮ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের বাসিন্দা রসরাজ দাসের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কাবাঘরের ছবি সম্পাদনা করে পোস্ট করা হয়। এ নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠার পর স্থানীয় লোকজন তাঁকে পুলিশে দেয়।
এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে পরের দিন ২৯ অক্টোবর দিনভর নাসিরনগর সদর উত্তাল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পরের দিন ৩০ অক্টোবর উপজেলা সদরের কলেজ মোড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সমাবেশ চলাকালে সদরের একাধিক মন্দির ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
এ ঘটনার পর ৪ নভেম্বর উপজেলায় হিন্দুদের পাঁচটি ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ৫ নভেম্বর নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেবের গোয়ালঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর ১৬ নভেম্বর তাঁর বাড়ির আঙিনায় রাখা পাটখড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর এবং লুটপাটের ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেন ও নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদেরকে প্রত্যাহার করা হয়। সহিংসতার ঘটনায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগ। তাঁরা হলেন নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক আহম্মেদ, চাপড়তলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক আবুল হাশেম। এ ছাড়া গত ২৭ ডিসেম্বর নাসিরনগরের হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল আহাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর গত ৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ আলীকে তাঁর গ্রামের বাড়ি চাপরতলা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁকে দুদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
নাসিরনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইশতিয়াক আহমেদ জানান, গত বছরের ৩০ অক্টোবর গৌর মন্দিরে হামলায় ভাঙচুরের মামলায় সুরুজ আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পর্যায়ক্রমে তাঁকে বাকি মামলাগুলোতেও গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতা সুরুজ আলীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার দিন নাসিরনগরে হওয়া একটি সমাবেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন সুরুজ আলী। তাঁর এ বক্তব্যের পরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে; হামলা-ভাঙচুর শুরু হয়। ঘটনার পর পরই সুরুজ আলী গা-ঢাকা দেন।
এদিকে গত ২৮ নভেম্বর জেলা পুলিশের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে রসরাজের ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে ধর্ম অবমাননাকর সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়নি বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফরেনসিক বিভাগ। গত ১৬ জানুয়ারি রসরাজ দাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। পরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।